চায়ের দরকার নেই, আমরা খেয়ে-দোয়ে বেরিয়েছি। আপনি কোথাও যাবেন মনে হচ্ছে।’
নকুলেশবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ, দু’ দিনের জন্য একবার কলকাতা যাব। বৌ-ছেলে কলকাতায় আছে তাদের আনতে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা, আপনি গোছগাছ করুন।’
রিকশাতে চড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘স্টেশনে চল।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ব্যাপার কি? সবাই জোট বেঁধে কলকাতা যাচ্ছে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই সময় কলকাতার একটা নিদারুণ আকর্ষণ আছে।’
রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। ব্রাঞ্চ লাইনের প্রান্তীয় স্টেশন, বেশি বড় নয়। এখান হইতে বড় জংশন প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে, সেখানে নামিয়া মেন লাইনের গাড়ি ধরিতে হয়। রেল ছাড়া জংশনে যাইবার মোটর-রাস্তাও আছে; সাহেব সুবা এবং যাহাদের মোটর আছে তাহারা সেই পথে যায়।
ব্যোমকেশ কিন্তু স্টেশনে নামিল না, রিকশাওয়ালাকে ইশারা করিতেই সে গাড়ি ঘুরাইয়া বাহিরে লইয়া চলিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হল, নামলে না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুমি বোধ হয় লক্ষ্য করনি, টিকিট-ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ঘটক টিকিট কিনছিল।’
‘তাই নাকি?’ আমি ব্যোমকেশকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু সে যেন শুনিতে পায় নাই এমনি ভান করিয়া উত্তর দিল না।
বাজারের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে বড় মনিহারীর দোকানটার সামনে একটা মোটর দাঁড়াইয়া আছে দেখিলাম। ব্যোমকেশ রিকশা থামাইয়া নামিল, আমিও নামিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আবার কি মতলব? আরও এসেন্স চাই নাকি?’
সে হাসিয়া বলিল, ‘আরে না না–’
‘তবে কি কেশতৈল? তরল আলতা?’
‘এসই না।’
দোকানে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ডেপুটি ঊষানাথবাবু রহিয়াছেন। তিনি একটা চামড়ার সুটকেস কিনিতেছেন। আমার মুখ দিয়া আপনিই বাহির হইয়া গেল, ‘আপনিও কি কলকাতা যাচ্ছেন নাকি?’
ঊষানাথবাবু চমকিত হইয়া বলিলেন, ‘আমি! নাঃ, আমি ট্রেজারি অফিসার, আমার কি স্টেশন ছাড়বার জো আছে? কে বললে আমি কলকাতা যাচ্ছি?’ তাঁহার স্বর কড়া হইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সান্ত্বনার সুরে বলিল, ‘কেউ বলেনি। আপনি সুটকেস কিনছেন দেখে অজিত ভেবেছিল–। যাক, আপনার পরী পেয়েছেন তো?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি।’ ঊষানাথবাবু অসন্তুষ্টভাবে মুখ ফিরাইয়া লইয়া দোকানদারের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন।
আমরা ফিরিয়া গিয়া রিকশাতে চড়িলাম। বলিলাম, ‘কি হল? হুজুর হঠাৎ চটলেন কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি জানি। ওঁর হয়তো মনে মনে কলকাতা যাবার ইচ্ছে, কিন্তু কৰ্তব্যের দায়ে স্টেশন ছাড়তে পারছেন না, তাই মেজাজ গরম। কিংবা—’
রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, ‘আভি কিধর যানা হ্যায়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডি.এস.পি. পাণ্ডে সাহেব।’
পাণ্ডে সাহেবের বাড়িতেই আপিস। তিনি আমাদের স্বাগত করিলেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘সব ঠিক?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘সব ঠিক।’
‘ট্রেন কখন?’
‘রাত্রি সাড়ে দশটায়। সওয়া এগারটায় জংশন পৌঁছবে।’
‘কলকাতার ট্রেন কখন?’
‘পৌনে বারটায়।’
‘আর পশ্চিমের মেল?’
‘এগারটা পঁয়ত্ৰিশ।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ। তাহলে ওবেলা আন্দাজ পাঁচটার সময় আমি মহীধর বাবুর বাড়িতে যাব। আপনি সাড়ে পাঁচটার সময় যাবেন। মহীধরবাবু যদি আমার অনুরোধ না রাখেন, পুলিসের অনুরোধ নিশ্চয় অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।’
গম্ভীর হাসিয়া পাণ্ডে বলিলেন, ‘আমারও তাই বিশ্বাস।’
ইহাদের টেলিগ্ৰাফে কথাবার্তা হৃদয়ঙ্গম হইল না। কিন্তু প্রশ্ন করিয়া লাভ নাই; জানি প্রশ্ন করিলেই ব্যোমকেশ জিভ কাটিয়া বলিবে-পুলিসের গুপ্তকথা।
পাণ্ডের আপিস হইতে ব্যাঙ্কে গেলাম। কিছু টাকা বাহির করিবার ছিল।
ব্যাঙ্কে খুব ভিড়; আগামী দুই দিন বন্ধ থাকিবে। তবু ক্ষণেকের জন্য অমরেশবাবুর সঙ্গে দেখা হইল। তিনি বলিলেন, ‘এই বেলা যা দরকার টাকা বার করে নিন। কাল পরশু ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকবে।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি ফিরছেন কবে?’
‘পরশু রাত্রেই ফিরব।’
কাজের সময়, একজন কেরানী তাঁহাকে ডাকিয়া লইয়া গেল। আমরা টাকা বাহির করিয়া ফিরিতেছি, দেখিলাম ডাক্তার ঘটক ব্যাঙ্কে প্ৰবেশ করিল। সে আমাদের দেখিতে পাইয়াছিল, কিন্তু যেন দেখিতে পায় নাই এমনিভাবে গিয়া একটা জানালার সম্মুখে দাঁড়াইল।
ব্যোমকেশ আমার দিকে চাহিয়া সহাস্য চক্ষুদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত করিল। তারপর রিকশাতে চড়িয়া বসিয়া বলিল, ‘ঘর চলো।’
১১
অপরাহ্ন পাঁচটার সময় আমি আর ব্যোমকেশ মহীধরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। তিনি বসিবার ঘরে ছিলেন। দেখিলাম তাঁহার চেহারা খারাপ হইয়া গিয়াছে। মুখের ফুটি-ফাটা হাসিটি ম্ৰিয়মাণ, চালতার মতন গাল দুইটি বুলিয়া পড়িয়াছে।
বলিলেন, ‘আসুন আসুন। অনেক দিন বাঁচবেন ব্যোমকেশবাবু্, এইমাত্র আপনার কথা ভাবছিলাম। শরীর বেশ সেরে উঠেছে দেখছি। বাঃ, বেশ বেশ।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আপনার শরীর তো ভাল দেখছি না।’
মহীধরবাবু বলিলেন, ‘হয়েছিল একটু শরীর খারাপ—এখন ভালই। কিন্তু একটা বড় ভাবনার কারণ হয়েছে ব্যোমকেশবাবু।’
‘কি হয়েছে?’
‘রাজনী কাল রাত্রে কলকাতা চলে গেছে।’
‘সে কি! একলা গেছেন? আপনাকে না বলে?’
‘না না, সে সব কিছু নয়। বাড়ির পুরোনো চাকর রামদীনকে তার সঙ্গে দিয়েছি।’
‘তবে ভাবনাটা কিসের?’
মহীধরবাবুর মনে ছল চাতুরী নাই। সোজাসুজি বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘শুনুন, বলি তাহলে। কলকাতায় রজনীর এক মাসী থাকেন, তিনিই ওকে মানুষ করেছেন। কাল বিকেলে ওর মেসোর এক ‘তার’ এল। তিনি রজনীকে ডেকে পাঠিয়েছেন—মাসীর ভারি অসুখ। রজনীকে রাত্তিরের গাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। ও এমন প্রায়ই যাতায়াত করে, পাঁচ ছাঁ ঘণ্টার রাস্তা বৈ তো নয়। রজনী আজ সকালে কলকাতায় পৌঁছে গেছে, ‘তার’ পেয়েছি।