প্রোফেসর সোম একবার নিজের বাড়ির দ্বিতলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘যাব। কিন্তু গিন্নীর এখনও প্রসাধন শেষ হয়নি। আপনারা এগোন।’
আমরা রিকশাতে চড়িয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী একটাতে বসিল, অন্যটাতে আমি একা। ঘণ্টি বাজাইয়া মনুষ্য-চালিত ত্রিচক্র-যান ছাড়িয়া দিল। ব্যোমকেশের মুখে হাসি ফুটিল। সত্যবতী সযত্নে তাহার গায়ে শাল জড়াইয়া দিল। অতর্কিতে ঠাণ্ডা লাগিয়া না যায়।
কাঁকর-ঢাকা উঁচু-নীচু রাস্তা দিয়া দুই দিক দেখিতে দেখিতে চলিয়াছি। রাস্তার দু’ধারে ঘরবাড়ির ভিড় নাই, এখানে একটা ওখানে একটা। শহরটি যেন হাত-পা ছড়াইয়া অসমতল পাহাড়তলির উপর অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছে, গাদাগাদি ঠেসাঠেসি নাই। আয়তনে বিস্তৃত হইলেও নগরের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সমৃদ্ধি আছে। আশেপাশে কয়েকটি অভ্রের খনি এখানকার সমৃদ্ধির প্রধান সূত্র। আদালত আছে, ব্যাঙ্ক আছে। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যাঁরা গণ্যমান্য তাঁরা প্ৰায় সকলেই বাঙালী।
যিনি আমাদের নিমন্ত্ৰণ করিয়াছেন তাঁহার নাম মহীধর চৌধুরী। অধ্যাপক সোমের কাছে শুনিয়াছি ভদ্রলোক প্রচুর বিত্তশালী; বয়সে প্রবীণ হইলেও সর্বদাই নানাপ্রকার হুজুগ লইয়া আছেন; অর্থব্যয়ে মুক্তহস্ত। তাঁহার প্রযোজনায় চড়ুইভাতি, শিকার, খেলাধূলা লাগিয়াই আছে।
মিনিট দশ পনেরোর মধ্যে তাঁহার বাসভবনের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। প্রায় দশ বিঘা জমি পাথরের পাঁচিল দিয়া ঘেরা, হঠাৎ দুর্গ বলিয়া ভ্রম হয়। ভিতরে রকমারি গাছপালা, মরসুমী ফুলের কেয়ারি, উঁচু-নীচু পাথুরে জমির উপর কোথাও লাল-মাছের বাঁধানো সরোবর, কোথাও নিভৃত বেতসকুঞ্জ, কোথাও বা কৃত্রিম ক্রীড়াশৈল। সাজানো বাগান দেখিয়া সহসা বনানীর বিভ্রম উপস্থিত হয়। মহীধরবাবু যে ধন্যবান তাহা তাঁহার বাগান দেখিয়া বুঝিতে কষ্ট হয় না।
বাড়ির সম্মুখে ছাঁটা ঘাসের সমতল টেনিস কোর্ট, তাহার উপর টেবিল চেয়ার প্রভৃতি সাজাইয়া নিমন্ত্রিতদের বসিবার স্থান হইয়াছে, শীতের বৈকালী রৌদ্র স্থানটিকে আতপ্ত করিয়া রাখিয়াছে। সুন্দর দোতলা বাড়িটি যেন এই দৃশ্যের পশ্চাৎপট রচনা করিয়াছে। আমরা উপস্থিত হইলে মহীধরবাবু সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করিলেন। ভদ্রলোকের দেহায়তন বিপুল, গৌরবর্ণ দেহ, মাথায় সাদা চুল ছোট করিয়া ছাঁটা, দাড়ি-গোঁফ কামানো গাল দুটি চালতার মত, মুখে ফুটিফাটা হাসি। দেখিলেই মনে হয় অমায়িক ও সরল প্রকৃতি লোক।
তিনি তাঁহার মেয়ে রজনীর সহিত আমাদের পরিচয় করাইয়া দিলেন। মেয়েটির বয়স ’কুড়ি-একুশ, সুশ্ৰী গৌরাঙ্গী হাস্যমুখী; ভাসা-ভাসা চোখ দুটিতে বুদ্ধি ও কৌতুকের খেলা। মহীধরবাবু বিপত্নীক, এই মেয়েটি তাঁহার জীবনের একমাত্র সম্বল এবং উত্তরাধিকারিণী।
রজনী মুহুর্তমধ্যে সত্যবতীর সহিত ভােব করিয়া ফেলিল এবং তাহাকে লইয়া দূরের একটা সোফাতে বসাইয়া গল্প জুড়িয়া দিল। আমরাও বসিলাম। অতিথিরা এখনও সকলে আসিয়া উপস্থিত হন নাই, কেবল ডাক্তার অশ্বিনী ঘটক ও আর একটি ভদ্রলোক আসিয়াছেন। ডাক্তার ঘটক আমাদের পরিচিত, পূর্বেই বলিয়াছি; অন্য ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ হইল। এর নাম নকুলেশ সরকার; শহরের একজন মধ্যম শ্রেণীর ব্যবসাদার, তা ছাড়া ফটোগ্রাফির দোকান আছে। ফটোগ্রাফি করেন শখের জন্য, উপরন্তু এই সূত্রে কিছু-কিঞ্চিৎ উপার্জন হয়। শহরে অন্য ফটোগ্রাফার নাই।
সাধারণভাবে কথাবার্তা হইতে লাগিল। মহীধরবাবু এক সময় ডাক্তার ঘটককে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘ওহে ঘোটক, তুমি অ্যাদিনেও ব্যোমকেশবাবুকে চাঙ্গা করে তুলতে পারলে না! তুমি দেখছি নামেও ঘোটক কাজেও ঘোটক—একেবারে ঘোড়ার ডাক্তার!’ বলিয়া নিজের রসিকতায় হা-হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
নকুলেশবাবু ফোড়ন দিয়া বলিলেন, ‘ঘোড়ার ডাক্তার না হয়ে উপায় আছে? একে অশ্বিনী তায় ঘোটক।’
ডাক্তার ইঁহাদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, সে একটু হাসিয়া রসিকতা হজম করিল। ডাক্তারকে লইয়া অনেকেই রঙ্গ-রসিকতা করে দেখিলাম, কিন্তু তাহার চিকিৎসা-বিদ্যা সম্বন্ধে সকলেই শ্রদ্ধাশীল। শহরে আরও কয়েকজন প্রবীণ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু এই তুরুণ সৎস্বভাব ডাক্তারটি মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে বেশ পসার জমাইয়া তুলিয়াছে।
ক্রমে অন্যান্য অতিথিরা আসিতে আরম্ভ করিলেন। প্রথমে আসিলেন সস্ত্রীক সপুত্র উষ্যনাথ ঘোষ। ইনি একজন ডেপুটি, এখানকার সরকারী মালখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী। লম্বা-চওড়া চেহারা, খসখসে কালো রঙ, চোখে কালো কাচের চশমা। বয়স আন্দাজ পয়ত্ৰিশ, গভীরভাবে থামিয়া থামিয়া কথা বলেন, গভীরভাবে হাসেন। তাঁহার স্ত্রীর চেহারা রুগ্ন, মুখে উৎকণ্ঠার ভাব, থাকিয়া থাকিয়া স্বামীর মুখের পানে উদ্বিগ্ন চক্ষে দৃষ্টিপাত করেন। ছেলেটি বছর পাঁচেকের; তাহাকে দেখিয়াও মনে হয় যেন সর্বদা শঙ্কিত সঙ্কুচিত হইয়া আছে। ঊষানাথবাবু সম্ভবত নিজের পরিবারবর্গকে কঠিন শাসনে রাখেন, তাঁহার সম্মুখে কেহ মাথা তুলিয়া কথা বলিতে পারে না।
মহীধরবাবু আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়া দিলে তিনি গম্ভীর মুখে গলার মধ্যে দুই চারিটি শব্দ উচ্চারণ করিলেন; বোধ হয় তাহা লৌকিক সম্ভাষণ, কিন্তু আমরা কিছু শুনিতে পাইলাম না। তাঁহার চক্ষু দুইটি কালো কাচের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া রহিল। একটু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলাম। যাহার চোখ দেখিতে পাইতেছি না। এমন লোকের সঙ্গে কথা কহিয়া সুখ নাই।