চিত্রচোর

‘বাকি রয়ে গেলেন ডেপুটি ঊষানাথবাবু এবং ব্যাঙ্ক-ম্যানেজার অমরেশ রাহা। একজন সরকারী মালখানার মালিক‌, অন্যজন ব্যাঙ্কের কতা। দেখা যাচ্ছে‌, ফেরার হয়ে যদি কারুর লাভ থাকে তো এঁদের দু’জনের। দু’জনের হাতেই বিস্তর পরের টাকা; দু’জনেই চিনির বলদ।

‘প্রথমে ঊষানাথবাবুকে ধর। তাঁর স্ত্রী-পুত্ৰ আছে; চেহারাখানাও এমন যে ফটো না থাকলেও তাঁকে সনাক্ত করা চলে। তিনি চোখে কালো চশমা পরেন‌, চশমা খুললে দেখা যায়। তাঁর একটা চোখ কানা। বেশিদিন পুলিসের সন্ধানী চক্ষু এড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া‌, তাঁর চরিত্রও এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করার প্রতিকূল।

‘বাকি রইলেন অমরেশ রাহা। এটা অবশ্য নেতি প্ৰমাণ। কিন্তু তারপর তাঁকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবে তিনি ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। তাঁর চেহারা নিতান্ত সাধারণ‌, তাঁর মত লক্ষ লক্ষ বৈশিষ্ট্যহীন লোক পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি মুখে ফ্রেঞ্চকার্ট দাড়ি রেখেছেন। এ রকম দাড়ি রাখার সুবিধে‌, দাড়ি কামিয়ে ফেললেই চেহারা বদলে যায়‌, তখন চেনা লোক আর চিনতে পারে না। নকল দাড়ি পরার চেয়ে তাই আসল দাড়ি কামিয়ে ফেলা ছদ্মবেশ হিসেবে ঢের বেশি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য।

‘অমরেশবাবু অবিবাহিত ছিলেন। তিনি মাইনে ভালই পেতেন‌, তবু তাঁর মনে দারিদ্র্যের ক্ষোভ ছিল; টাকার প্রতি দুৰ্দম আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল। আমার মনে হয় তিনি অনেকদিন ধরে এই কু-মতলব আঁটছিলেন। তাঁর আলমারিতে গুজরাটী বই দেখেছিলে মনে আছে? তিনি চেষ্টা করে গুজরাটী ভাষা শিখেছিলেন; হয়তো সংকল্প ছিল টাকা নিয়ে বোম্বাই অঞ্চলে গিয়ে বসবেন। বাঙালীদের সঙ্গে গুজরাটীদের চেহারার একটা ধাতুগত ঐক্য আছে‌, ভাষাটাও রপ্ত থাকলে কেউ তাঁকে সন্দেহ করতে পারবে না।

‘সবদিক ভেবে আটঘটি বেঁধে তিনি তৈরি হয়েছিলেন। তারপর যখন সঙ্কল্পকে কাজে পরিণত করবার সময় হল তখন হঠাৎ কতকগুলো অপ্রত্যাশিত বাধা উপস্থিত হল। পিকনিকের দলে গিয়ে তাঁকে ছবি তোলাতে হল। তিনি অনিচ্ছাভরে ছবি তুলিয়েছিলেন সন্দেহ নেই‌, কিন্তু না তোলাতে লোকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। ভাবলেন‌, ছবি চুরি করে সামলে নেবেন।

‘যা হোক‌, তিনি মহীধর বাবুর বাড়ি থেকে ছবি চুরি করলেন। পরদিন চায়ের পার্টিতে আমরা উপস্থিত ছিলাম; সেখানে যে সব আলোচনা হল তাতে অমরেশবাবু বুঝলেন তিনি একটা ভুল করেছেন। স্রেফ ছবিখানা চুরি করা ঠিক হয়নি। তাই পরের বার যখন তিনি ঊষানাথবাবুর বাড়িতে চুরি করতে গেলেন তখন আর কিছু না পেয়ে পরী চুরি করে আনলেন। আলমারিতে চাবি ঢুকিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন যাতে মনে হয় ছবি চুরি করাটা চোরের মূল উদ্দেশ্য নয়। অধ্যাপক সোমের ছবিটা চুরি করার দরকার হয়নি। আমার বিশ্বাস তিনি কোনও উপায়ে জানতে পেরেছিলেন যে‌, মালতী দেবী ছবিটা আগেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে‌, তিনি ছবি চুরি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি তার আগেই নষ্ট করা হয়েছিল। হয়তো তিনি ছেড়া ছবির টুকরোগুলো পেয়েছিলেন।

‘আমার আবিভাবে অমরেশবাবু শঙ্কিত হননি। তাঁর মূল অপরাধ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে; তিনি টাকা নিয়ে উধাও হবার পর সবাই জানতে পারবে‌, তখন আমি জানলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ফাল্গুনী পালের প্রেতিমূর্তি যখন এসে দাঁড়াল‌, তখন অমরেশবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। তাঁর সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে যাবার উপক্রম হল। ফাল্গুনী থাকতে ফটো চুরি করে কি লাভ? সে স্মৃতি থেকে ছবি এঁকে ফটোর অভাব পূরণ করে দেবে।

‘কিন্তু পরকীয়া-প্রীতির মত বেআইনী কাজ করার একটা তীব্ৰ উত্তেজনা আছে। অমরেশবাবু তার স্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি এতদূর এগিয়ে আর পৌঁছুঁতে পারছিলেন না। তাই ফাল্গুনী যেদিন তাঁর ছবি এঁকে দেখাতে এল সেদিন তিনি ঠিক করলেন ফাল্গুনীর বেঁচে থাকা চলবে না। সেই রাত্রে তিনি মদের বোতলে বেশ খানিকটা আফিম মিশিয়ে নিয়ে ফাল্গুনীর কুঁড়ে ঘরে গেলেন। ফাল্গুনীকে নেশার জিনিস খাওয়ানো শক্ত হল না। তারপর সে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ল তখন তাকে তুলে কুয়োয় ফেলে দিলেন। আগের রাত্রে চুরি-করা পরীটা তিনি সঙ্গে এনেছিলেন‌, সেটাও কুয়োর মধ্যে গেল; যাতে পুলিস ফাল্গুনীকেই চোর বলে মনে করে। এই ব্যাপার ঘটেছিল সম্ভবত রাত্রি এগারোটার পর‌, যখন বাগানের অন্য কোণে আর একটি মন্ত্রণা-সভা শেষ হয়ে গেছে।

‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট থেকে মনে হয় ফাল্গুনী জলে পড়বার আগেই মরে গিয়েছিল। কিন্তু অমরেশবাবুর বোধ হয়। ইচ্ছে ছিল সে বেঁচে থাকতে থাকতেই তাকে জলে ফেলে দেন‌, যাতে প্রমাণ হয় সে নেশার ঝোঁক অপঘাতে জলে ডুবে মরেছে।

‘যা হোক‌, অমরেশবাবু নিষ্কণ্টক হলেন। যে ছবিটা তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন‌, রওনা দেবার আগে সেটা পুড়িয়ে ফেললেই নিশ্চিন্ত্‌্‌, আর তাঁকে সনাক্ত করবার কোনও চিহ্ন থাকবে নী {

‘আমি যখন নিঃসংশয়ে বুঝতে পারলাম। এ অমরেশবাবুর কাজ‌, তখন পাণ্ডে সাহেবকে সব কথা বললাম। ভারি বুদ্ধিমান লোক‌, চট করে ব্যাপার বুঝে নিলেন। সেই থেকে এক মিনিটের জন্যেও অমরেশবাবু পুলিসের চোখের আড়াল হতে পারেননি।’

ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল।

আমি বলিলাম‌, আচ্ছা‌, অমরেশ রাহা যে ঠিক ঐ দিনই পালাবে‌, এটা বুঝলে কি করে? অন্য যে কোনও দিন পালাতে পারত।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটা কোনও ছুটির আগে পালানোর সুবিধে আছে‌, দুদিন সময় পাওয়া যায়। দুদিন পরে ব্যাঙ্ক খুললে যখন চুরি ধরা পড়বে‌, চোর তখন অনেক দূরে। অবশ্য বড়দিনের ছুটিতেও পালাতে পারত; কিন্তু তার দিক থেকে নববর্ষের ছুটিতেই পালানোর দরকার ছিল। অমরেশ রাহা যে-ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিল সেটা কলকাতার একটা বড় ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ অফিস। প্রত্যেক মাসের শেষে এখানে হেড আপিস থেকে মোটা টাকা আসত; কারণ পরের মাসের আরম্ভেই ব্যাঙ্কের টাকায় টান পড়বে। সাধারণ লোক ছাড়াও এখানে কয়েকটা খনি আছে‌, তাতে অনেক কমী কাজ করে‌, মাসের পয়লা তাদের মাইনে দিতে হয়। এবার সেই মোটা টাকাটা ব্যাঙ্কে এসেছিল বড়দিনের ছুটির পর। বড়দিনের ছুটির আগে পালালে অমরেশ রাহা বেশি টাকা নিয়ে যেতে পারত না। তার দুটি সুটকেশ থেকে এক লাখ আশি হাজার টাকার নোট পাওয়া গেছে।’

0 Shares