চিত্রচোর

তারপর আসিলেন পুলিসের ডি.এস.পি‌, পুরুন্দর পাণ্ডে। ইনি বাঙালী নন‌, কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলেন; বাঙালীর সহিত মেলামেশা করিতেও ভালবাসেন। লোকটি সুপুরুষ‌, পুলিসের সাজ-পোশাকে দিব্য মানাইয়াছে। ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন‌, ‘আপনি এসেছেন‌, কিন্তু এমনি আমাদের দুভাগ্য একটি জটিল রহস্য দিয়ে যে আপনাকে সংবর্ধনা করব তার উপায় নেই। আমাদের এলাকায় রহস্য জিনিসটার একান্ত অভাব। সব খোলাখুলি। চুরি-বাটপাড়ি যে হয় না তা নয়‌, কিন্তু তাতে বুদ্ধি খেলাবার অবকাশ নেই।’

ব্যোমকেশও হাসিয়া বলিল‌, ‘সেটা আমার পক্ষে ভালই। জটিল রহস্য এবং আরও অনেক লোভনীয় বস্তু থেকে আমি উপস্থিত বঞ্চিত। ডাক্তারের বারণ।’

এই সময় আর একজন অতিথি দেখা দিলেন। ইনি স্থানীয় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা। কৃশ ব্যক্তিত্বহীন চেহারা‌, তাই বোধ করি মুখে ফ্রেঞ্চকার্ট দাড়ি রাখিয়া চেহারায় একটু বৈশিষ্ট্য দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বয়স যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের মাঝামাঝি একটা অনির্দিষ্ট স্থানে।

মহীধরবাবু বলিলেন‌, ‘অমরেশবাবু্‌, আপনি ব্যোমকেশবাবুকে দেখবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলেন–এই নিন।’

অমরেশবাবু নমস্কার করিয়া সহাস্যে বলিলেন‌, ‘কীর্তিমান পুরুষকে দেখবার ইচ্ছা কার না হয়? আপনারাও কম ব্যস্ত হননি‌, শুধু আমাকে দোষ দিলে চলবে কেন?’

মহীধরবাবু বলিলেন‌, ‘কিন্তু আজ আসতে বড় দেরি করেছেন। সকলেই এসে গেছেন‌, কেবল প্রোফেসর সোম বাকি। তা তাঁর না হয় একটা ওজুহাত আছে। মেয়েদের সাজসজ্জা করতে একটু দেরি হয়। আপনার সে। ওজুহাতও নেই। ব্যাঙ্ক তো সাড়ে তিনটের সময় বন্ধ হয়ে গেছে।’

অমরেশ রাহা বলিলেন‌, ‘তাড়াতাড়ি আসব ভেবেছিলাম। কিন্তু বড়দিন এসে পড়ল‌, এখন কাজের চাপ একটু বেশি। বছর ফুরিয়ে আসছে। নূতন বছর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো আপনারা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনতে আরম্ভ করবেন। তার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে তো।’

ইতিমধ্যে কয়েকজন ভৃত্য বাড়ির ভিতর হইতে বড় বড় ট্রেতে করিয়া নানাবিধ খাদ্য-পানীয় আনিয়া টেবিলগুলির উপর রাখিতেছিল; চা‌, কেক‌, সন্দেশ‌, পাঁপরিভাজা‌, ডালমুট ইত্যাদি। রজনী উঠিয়া গিয়া খাবারের প্লেটগুলি পারিবেশন করিতে লাগিল। কেহ কেহ নিজেই গিয়া প্লেট তুলিয়া লইয়া আহার আরম্ভ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসি গল্প আলাপ-আলোচনা চলিল।

রজনী মিষ্টান্নের একটি প্লেট লইয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে দাঁড়াইল‌, হাসিমুখে বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, একটু জলযোগ।’

ব্যোমকেশ আড়চোখে একবার সত্যবতীর দিকে তাকাইল‌, দেখিল সত্যবতী দূর হইতে একদৃষ্টি তাহার পানে চাহিয়া আছে। ব্যোমকেশ ঘাড় চুলকাইয়া বলিল‌, ‘আমাকে মাপ করতে হবে। এসব আমার চলবে না।’

মহীধরবাবু ঘুরিয়া ফিরিয়া খাওয়া তদারক করিতেছিলেন‌, বলিলেন‌, ‘সে কি কথা! একেবারেই চলবে না? একটু কিছু—? ওহে‌, ডাক্তার‌, তোমার রোগীর কি কিছুই খাবার হুকুম নেই?

ডাক্তার টেবিলের নিকট দাঁড়াইয়া এক মুঠি ডালমুট মুখে ফেলিয়া চিবাইতেছিল‌, বলিল‌, ‘না খেলেই ভাল।’

ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল‌, ‘শুনলেন তো! আমাকে শুধু এক পেয়ালা চা দিন। ভাববেন। না‌, আবার আমরা আসব; আজকের আসাটা মুখবন্ধ মাত্র।’

মহীধরবাবু খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আমার বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা কেউ না কেউ পায়ের ধুলো দেন। আপনারাও যদি মাঝে মাঝে আসেন সান্ধ্য-বৈঠক জমবে ভাল।’

এতক্ষণে অধ্যাপক সোম সস্ত্রীক আসিয়া পৌঁছিলেন। সোমের একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব। বস্তুত লজ্জা না হওয়াই আশ্চর্য। সোম-পত্নী মালতী দেবীর বর্ণনা আমরা এখনও দিই নাই‌, কিন্তু আর না দিলে নয়। বয়সে তিনি স্বামীর প্রায় সমকক্ষ; কালো মোটা শরীর‌, থলথলে গড়ন‌, ভাঁটার মত চক্ষু সর্বদাই গর্বিতভাবে ঘুরিতেছে; মুখশ্ৰী দেখিয়া কেহ মুগ্ধ হইবে সে সম্ভাবনা নাই। উপরন্তু তিনি সাজ-পোশাক করিয়া থাকিতে ভালবাসেন। আজ যেরূপ সবলিঙ্কার ভূষিতা হইয়া চায়ের জলসায় আসিয়াছেন তাহাতে ইন্দ্রপুরীর অন্সরাদেরও চমক লাগিবারর কথা। পরিধানে ডগডগে। লাল মাদ্রাজী সিস্কের শাড়ি‌, তার উপর সবঙ্গে হীরা-জহরতের গহনা। তাঁহার পাশে সোমের কুষ্ঠিত ত্ৰিয়মাণ মূর্তি দেখিয়া আমাদেরই লজ্জা করিতে লাগিল।

রজনী তাড়াতাড়ি গিয়া তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিল‌, কিন্তু মালতী দেবীর মুখে হাসি ফুটিল না। তিনি বক্ৰচক্ষে রজনীর মুখ হইতে স্বামীর মুখ পর্যন্ত দৃষ্টির একটি কশাঘাত করিয়া চেয়ারে গিয়া বসিলেন।

খাওয়া এবং গল্প চলিতে লাগিল। ব্যোমকেশ মুখে শহীদের ন্যায় ভাবব্যঞ্জনা ফুটাইয়া চুমুক দিয়া দিয়া চা খাইতেছে; আমি নকুলেশবাবুর সহিত আলাপ করিতে করিতে পানাহার করিতেছি; ঊষানাথবাবু গভীরমুখে পুরন্দর পাণ্ডের কথা শুনিতে শুনিতে ঘাড় নাড়িতেছেন; তাঁহার ছেলেটি লুব্ধভাবে খাবারের টেবিলের দিকে অগ্রসর হইয়া শঙ্কিত-মুখে আবার ফিরিয়া আসিতেছে; তাহার মা খাবারের একটি প্লেট হাতে ধরিয়া পৰ্য্যয়ক্রমে ছেলে ও স্বামীর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিপাত করিতেছেন।

এই সময় বাক্যালাপের মিলিত কলম্বরের মধ্যে মহীধর বাবুর ঈষদুচ্চি কণ্ঠ শোনা গেল‌, ‘মিস্টার পাণ্ডে খানিক আগে বলছিলেন যে আমাদের এলাকায় জটিল রহস্যের একান্ত অভাব। একথা কতদূর সত্য আপনারাই বিচার করুন। কাল রাত্রে আমার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল।’

স্বরগুঞ্জন নীরব হইল; সকলের দৃষ্টি গিয়া পড়িল মহীধরবাবুর উপর। তিনি হাস্যবিকশিত মুখে দাঁড়াইয়া আছেন‌, যেন সংবাদটা ভারি কৌতুকপ্রদ।

0 Shares