অমরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কিছু চুরি গেছে নাকি?’
মহীধরবাবু বলিলেন, ‘সেইটেই জটিল রহস্য। ড্রয়িংরুমের দেয়াল থেকে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ চুরি গেছে। রাত্রে কিছু জানতে পারিনি, সকালবেলা দেখলাম ছবি নেই–আর একটা জানালা খোলা রয়েছে।’
পুরন্দর পাণ্ডে তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ‘ছবি! কোন ছবি?’
‘একটা গ্রুপ-ফটোগ্রাফ। মাসখানেক আগে আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম, সেই সময় নকুলেশবাবু তুলেছিলেন।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘হঁ। আর কিছু চুরি করেনি? ঘরে দামী জিনিস কিছু ছিল?’
মহীধরবাবু বলিলেন, ‘কয়েকটা রূপোর ফুলদানী ছিল; তা ছাড়া পাশের ঘরে অনেক রূপোর বাসন ছিল। চোর এসব কিছু না নিয়ে স্রেফ একটি ফটো নিয়ে পালাল। বলুন দেখি জটিল রহস্য কি না?’
পাণ্ডে তাচ্ছিল্যাভরে হাসিয়া বলিলেন, ‘জটিল রহস্য মনে করতে চান মনে করতে পারেন। আমার তো মনে হয় কোন জংলী সাঁওতাল জানোলা খোলা পেয়ে ঢুকেছিল, তারপর ছবির সোনালী ফ্রেমের লোভে ছবিটা নিয়ে গেছে।’
মহীধর বাবু বোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনার কি মনে হয়?’
মকেশ এতক্ষণ ইহাদের সওয়াল জবাব শুনিতেছিল বটে, কিন্তু তাহার চক্ষু অলসভাবে চারিদিকে ঘুরিতেছিল, সে এখন একটু সচেতন হইয়া বলিল, ‘মিস্টার পাণ্ডে ঠিকই ধরেছেন মনে হয়। নকুলেশবাবু্, আপনি ছবি তুলেছিলেন?’
নকুলেশবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ। ছবিখানা ভাল হয়েছিল। তিনি কপি ছেপেছিলাম। তার মধ্যে এক কপি মহীধরবাবু নিয়েছিলেন—’
ঊষানাথবাবু গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন, ‘আমিও একখানা কিনেছিলাম।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার ছবিখানা আছে তো?’
ঊষানাথবাবু বলিলেন, ‘কি জানি। অ্যালবামে রেখেছিলাম, তারপর আর দেখিনি। আছে নিশ্চয়।’
‘আর তৃতীয় ছবিটি কে নিয়েছিলেন নকুলেশবাবু?’
‘প্রোফেসর সোম।’
আমরা সকলে সোমের পানে তাকাইলাম। তিনি এতক্ষণ নির্জীবভাবে স্ত্রীর পাশে বসিয়াছিলেন, নিজের নাম উচ্চারিত হইতে শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন; তাঁহার মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিতে লাগিল। সোম-গৃহিণীর কিন্তু কোন প্রকার ভাবান্তর দেখা গেল না; তিনি কষ্টিপাথরের যক্ষিণীমূর্তির ন্যায় অটল হইয়া বসিয়া রহিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার ছবিটা নিশ্চয় আছে!’
সোম উত্তপ্তমুখে বলিলেন, ‘অ্যা-তা-বোধ হয়-ঠিক বলতে পারি না—’
তাঁহার ভাব দেখিয়া একটু বিস্মিত হইলাম। এমন কিছু গুরুতর বিষয় নয়, তিনি এমন অসম্বত হইয়া পড়িলেন কেন?
তাঁহাকে সঙ্কটাবস্থা হইতে উদ্ধার করিলেন অমরেশবাবু্, হাসিয়া বলিলেন, ‘তা গিয়ে থাকে যাক গে, আর একখানা নেবেন। নকুলেশবাবু্, আমারও কিন্তু একখানা চাই। আমিও গ্রুপে ছিলাম।’
নকুলেশবাবু মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, ‘ও ছবিটা আর পাওয়া যাবে না। নেগেটিভও খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘সে কি! কোথায় গেল নেগেটিভ?’
দেখিলাম, ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নকুলেশবাবুর পানে চাহিয়া আছে। তিনি বলিলেন, ‘আমার স্টুডিওতে অন্যান্য নেগেটিভের সঙ্গে ছিল। আমি দিন দুয়েকের জন্যে কলকাতা গিয়েছিলাম, স্টুডিও বন্ধ ছিল; ফিরে এসে আর সেটা খুঁজে পাচ্ছি না।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘ভাল করে খুঁজে দেখবেন। নিশ্চয়ই কোথাও আছে, যাবে কোথায়।’
এ প্রসঙ্গ লইয়া আর কোনও কথা হইল না। এদিকে সন্ধ্যার ছায়া ধীরে ধীরে ঘনাইয়া, আসিতেছিল। আমরা গাত্ৰোত্থানের উদ্যোগ করিলাম, কারণ সূৰ্য্যস্তের পর ব্যোমকেশকে বাহিরে রাখা নিরাপদ নয়।
এই সময় দেখিলাম একটি প্ৰেতাকৃতি লোক কখন আসিয়া মহীধরবাবুর পাশে দাঁড়াইয়াছে এবং নিম্নস্বরে তাঁহার সহিত কথা কহিতেছে। লোকটি যে নিমন্ত্রিত অতিথি নয় তাহা তাহার বেশবাস দেখিয়াই অনুমান করা যায়। দীর্ঘ কঙ্কালসার দেহে আধ-ময়লা ধুতি ও সুতির কামিজ, চক্ষু এবং গণ্ডস্থল কোটরপ্রবিষ্ট, যেন মূর্তিমান দুৰ্ভিক্ষ। তবু লোকটি যে ভদ্রশ্রেণীর তাহা বোঝা যায়।
মহীধরবাবু আমার অনতিদূরে উপবিষ্ট ছিলেন, তাই তাঁহাদের কথাবার্তা কানে আসিল। মহীধর বাবু একটু অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন, ‘আবার কি চাই বাপু? এই তো পরশু তোমাকে টাকা দিয়েছি।’
লোকটি ব্যগ্র-বিহ্বল স্বরে বলিল, ‘আজ্ঞে, আমি টাকা চাই না। আপনার একটা ছবি এঁকেছি, তাই দেখাতে এনেছিলাম।’
‘আমার ছবি!’
লোকটির হাতে এক তা পাকানো কাগজ ছিল, সে তাহা বুলিয়া মহীশ্বরবাবুর চোখের সামনে ধরিল।
মহীধরবাবু সবিস্ময়ে ছবির পানে চাহিয়া রহিলেন। আমারও কৌতুহল হইয়াছিল, উঠিয়া গিয়া মহীধরবাবুর চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইলাম।
ছবি দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম। সাদা কাগজের উপর ক্রেয়নের আঁকা ছবি, মহীধরবাবুর বুক পর্যন্ত প্রতিকৃতি; পাকা হাতের নিঃসংশয় কয়েকটি রেখায় মহীধরবাবুর অবিকল চেহারা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
আমার দেখাদেখি রজনীও আসিয়া পিতার পিছনে দাঁড়াইল এবং ছবি দেখিয়া সহৰ্ষে বলিয়া উঠিল, ‘বা। কি সুন্দর ছবি?
তখন আরও কয়েকজন আসিয়া জুটিলেন। ছবিখানা হাতে হাতে ঘুরিতে লাগিল এবং : সকলের মুখেই প্রশংসা গুঞ্জরিত হইয়া উঠিল। দুর্ভিক্ষপীড়িত চিত্রকর অদূরে দাঁড়াইয়া গদগদ মুখে দুই হাত ঘষিতে লাগিল।
মহীধরবাবু তাহাকে বলিলেন, ‘তুমি তো খাসা ছবি আঁকতে পার। তোমার নাম কি? চিত্রকর বলিল, ‘আজ্ঞে, আমার নাম ফাল্গুনী পাল।’
মহীধরবাবু পকেট হইতে একটি দশ টাকার নোট বাহির করিয়া প্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন, ‘বেশ বেশ। ছবিখানি আমি নিলাম। এই নাও তোমার পুরস্কার।’