চিত্রচোর

ফাল্গুনী পাল কাঁকড়ার মত হাত বাড়াইয়া তৎক্ষণাৎ নোট পকেটস্থ করিল।

পুরন্দর পাণ্ডে ললাট কুঞ্চিত করিয়া ছবিখানা দেখিতেছিলেন‌, হঠাৎ মুখ তুলিয়া ফাল্গুনীকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘তুমি ওঁর ছবি আঁকলে কি করে? ফটো থেকে?’

ফাল্গুনী বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, না। ওঁকে পরশুদিন একবার দেখেছিলাম-তাই—’

‘একবার দেখেছিলে তাতেই ছবি এঁকে ফেললে?’

ফাল্গুনী আমতা-আমতা করিয়া বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি পারি। আপনি যদি হুকুম দেন। আপনার ছবি এঁকে দেব।’

পাণ্ডে ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, বেশ। তুমি যদি আমার ছবি এঁকে আনতে পার‌, আমিও তোমাকে দশ টাকা বিকশিস দেব।’

ফাল্গুনী পাল সবিনয়ে সকলকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। পাণ্ডে ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘দেখা যাক। আমি ওঁদের পিকনিক গ্রুপে ছিলাম না।’

ব্যোমকেশ অনুমোদনসূচক ঘাড় নাড়িল।

অতঃপর সভা ভঙ্গ হইল। মহীধরবাবুর মোটর আমাদের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিল। সোম-দম্পতিও আমাদের সঙ্গে ফিরিলেন।

রাত্ৰি আন্দাজ আটটার সময় আমরা তিনজন বসিবার ঘরে দোরতাড়া বন্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম। নৈশ আহারের এখনও বিলম্ব আছে‌, ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় বসিয়া বলবর্ধক ডাক্তারি মদ্য চুমুক দিয়া পান করিতেছে; সত্যবতী তাহার পাশে একটা চেয়ারে র‍্যাপারে মুড়ি দিয়া বসিয়াছে। আমি সম্মুখে বসিয়া মাঝে মাঝে পকেট হইতে সিগারেটের ডিবা বাহির করিতেছি‌, আবার রাখিয়া দিতেছি। ব্যোমকেশের গঞ্জনা খাইবার আর ইচ্ছা নাই। চায়ের জলসার আলোচনাই হইতেছে।

আমি বলিলাম‌, ‘আমরা শিল্প-সাহিত্যের কত আদর করি ফাল্গুনী পাল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। লোকটা সত্যিকার গুণী‌, অথচ পেটের দায়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।’

ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক ছিল‌, বলিল‌, ‘পেটের দায়ে ভিক্ষে করছে তুমি জানলে কি করে?

বলিলাম‌, ‘ওর চেহারা আর কাপড়-চোপড় দেখে পেটের অবস্থা আন্দাজ করা শক্ত নয়।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল‌, ‘শক্ত নয় বলেই তুমি ভুল আন্দাজ করেছ। তুমি সাহিত্যিক‌, শিল্পীর প্রতি তোমার সহানুভুতি স্বাভাবিক। কিন্তু ফাল্গুনী পালের শারীরিক দুৰ্গতির কারণ অন্নাভাব নয়। আসলে খাদ্যের চেয়ে পানীয়ের প্রতি তার টান বেশি।’

‘অর্থাৎ মাতাল? তুমি কি করে বুঝলে?’

‘প্রথমত‌, তার ঠোঁট দেখে। মাতালের ঠোঁট যদি লক্ষ্য কর‌, দেখবে বৈশিষ্ট্য আছে; একটু ভিজে ভিজে‌, একটু শিথিল-ঠিক বোঝাতে পারব না‌, কিন্তু দেখলে বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত‌, ফাল্গুনী যদি ক্ষুধার্ত হয় তাহলে খাদ্যদ্রব্যগুলোর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করত‌, টেবিলের উপর তখনও প্রচুর খাবার ছিল। কিন্তু ফাল্গুনী সেদিকে একবার ফিরেও তাকাল না। তৃতীয়ত‌, আমার পাশ দিয়ে যখন চলে গেল তখন তার গায়ে মদের গন্ধ পেলাম। খুব স্পষ্ট নয়‌, তবু মদের গন্ধ।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বলবর্ধক ঔষধটি তুলিয়া লইয়া এক চুমুক পান করিল।

সত্যবতী বলিল‌, ‘যাক গে‌, মাতালের কথা শুনতে ভাল লাগে না। কিন্তু ছবি চুরির এ কি ব্যাপার গা? আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। মিছিমিছি ছবি চুরি করবে কেন?’

ব্যোমকেশ। কতকটা আপন মনেই বলিল‌, ‘হয়তো পাণ্ডেসাহেব ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু–। যদি তা না হয় তাহলে ভাববার কথা। …পিকনিকে গ্রুপ ছবি তোলা হয়েছিল। আজ চায়ের পার্টিতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই পিকনিকে ছিলেন-পাণ্ডে ছাড়া। …ছবির তিনটি কপি ছাপা হয়েছিল; তার মধ্যে একটা চুরি গেছে‌, বাকি দুটো আছে কিনা জানা যায়নি-নেগেটিভটাও পাওয়া যাচ্ছে না।—?’ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ ছাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল‌, ‘ইনি ছবির কথায় এমন ঘাবড়ে গেলেন কেন বোঝা গেল না।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর আমি বলিলাম‌, ‘কেউ যদি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটা সরিয়ে থাকে। তবে সে উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উদ্দেশ্য কি একটা অজিত? কে কোন মতলবে ফিরছে তা কি এত সহজে ধরা যায়? গহনা কর্মণো গতিঃ। সেদিন একটা মার্কিন পত্রিকায় দেখেছিলাম‌, ওদের চিড়িয়াখানাতে এক বানর-দম্পতি আছে। পুরুষ বাঁদরটা এমনি হিংসুটে‌, কোনও পুরুষ-দর্শক খাঁচার কাছে এলেই বৌকে টেনে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে।’

সত্যবতী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল‌, বলিল‌, ‘তোমার যত সব আষাঢ়ে গল্প। বাঁদরের কখনও এত বুদ্ধি হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা বুদ্ধি নয়‌, হৃদয়াবেগ; সরল ভাষায় যৌন ঈর্ষা। মানুষের মধ্যেও যে ও-বস্তুটি আছে। আশা করি তা অস্বীকার করবে না। পুরুষের মধ্যে তো আছেই‌, মেয়েদের মধ্যে আরও বেশি আছে। আমি যদি মহীধরবাবুর মেয়ে রজনীর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করি তোমার ভাল লাগবে না।’

সত্যবতী র‍্যাপারের একটা প্রান্ত ঠোঁটের উপর ধরিয়া নত চক্ষে চুপ করিয়া রহিল। আমি বলিলাম‌, কিন্তু এই ঈর্ষার সঙ্গে ছবি চুরির সম্বন্ধটা কি?’

‘যেখানে স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আছে সেখানেই এ ধরনের ঈর্ষা থাকতে পারে।’ বলিয়া ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বমুখে ছাদের পানে চাহিয়া রহিল।

বলিলাম, ‘মোটিত খুব জোরালো মনে হচ্ছে না। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে না কি?’

‘পারে। চিত্রকর ফাল্গুনী পাল চুরি করে থাকতে পারে। একটা মানুষকে একবার মাত্র দেখে সে ছবি আঁকতে পারে‌, তার এই দাবি সম্ভবত মিথ্যে। ফটো দেখে ছবি সহজেই আঁকা যায়। ফাল্গুনী সকলের চোখে চমক লাগিয়ে দিয়ে বেশি টাকা রোজগার করবার চেষ্টা করছে কিনা কে জানে!’

0 Shares