চিত্রচোর

দিন পাঁচ ছয় কাটিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশের শরীর এই কয়দিনে আরও সারিয়াছে। তাহার আহার্যের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাইয়াছে; সত্যবতী তাহাকে দিনে দুইটা সিগারেট খাইবার অনুমতি দিয়াছে। আমি নিত্য গুরুভোজনের ফলে দিন দিন খোদার খাসী হইয়া উঠিতেছি‌, সত্যবতীর গায়েও গত্তি লাগিয়াছে। এখন আমরা প্রত্যহ বৈকালে ব্যোমকেশকে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় পদচারণ করি‌, কারণ হওয়া বদলের ইহা একটা অপরিহার্য অঙ্গ। সকলেই খুশি।

একদিন আমরা পথ-ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছি‌, অধ্যাপক সোম আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন‌, বলিলেন‌, ‘চলুন‌, আজ আমিও আপনাদের সহযাত্রী।’

সত্যবতী একটু উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিল‌, ‘মিসেস সোম কি-?’

সোম প্ৰফুল্ল স্বরে বলিলেন‌, ‘তাঁর সর্দি হয়েছে। শুয়ে আছেন।’

সোম মিশুক লোক‌, কেবল স্ত্রী সঙ্গে থাকিলে একটু নিজীবী হইয়া পড়েন। আমরা নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

ছবি চুরির প্রসঙ্গ আপনা হইতেই উঠিয়া পড়িল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা বলুন দেখি‌, ঐ ছবিখানা কাগজে বা পত্রিকায় ছাপানোর কোনও প্ৰস্তাব হয়েছিল কি?’

সোম চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, তারপর ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন‌, ‘কৈ‌, আমি তো কিছু জানি না। তবে নকুলেশবাবু মাঝে কলকাতা গিয়েছিলেন। বটে। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে তিনি ছবি ছাপতে দেবেন কি? মনে হয় না। বিশেষত ডেপুটি ঊষানাথবাবু জানতে পারলে ভারি অসন্তুষ্ট হবেন।’

‘ঊষানাথবাবু অসন্তুষ্ট হবেন কেন?’

উনি একটু অদ্ভুত গোছের লোক। বাইরে বেশ গ্ৰাম্ভারি‌, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীরু প্রকৃতি। বিশেষত ইংরেজ মনিবকে (যে সময়ের গল্প তখনও ইংরেজ রাজত্ব শেষ হয় নাই) যমের মত ভয় করেন। সাহেবরা বোধ হয় চান না যে একজন হাকিম সাধারণ লোকের সঙ্গে ফটো তোলাবে‌, তাই ঊষানাথবাবুর ফটো তোলাতে ঘোর আপত্তি। মনে আছে‌, পিকনিকের সময় তিনি প্রথমটা ফটোর‌, দলে থাকতে চাননি‌, অনেক বলে-কয়ে রাজী করাতে হয়েছিল। এ ছবি যদি কাগজে ছাপা হয় নকুলেশবাবুর কপালে দুঃখ আছে।’

ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া বুঝিলাম সে মনে মনে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। সে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ঊষানাথবাবুকি সব সময়েই কালো চশমা পরে থাকেন?’

সোম বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। উনি বছর দেড়েক হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন‌, তার মধ্যে আমি ওঁকে কখনও বিনা চশমায় দেখিনি। হয়তো চোখের কোনও দুর্বলতা আছে; আলো সহ্য করতে পারেন না।’

ব্যোমকেশ ঊষানাথবাবু সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করিল না। হঠাৎ বলিল‌, ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার লোকটি কেমন?

সোম বলিলেন, ‘চতুর ব্যবসাদার, ঘটে বুদ্ধি আছে। মহীধরবাবুকে খোসামোদ করে চলেন, শুনেছি তাঁর কাছে টাকা ধার নিয়েছেন।’

‘তাই নাকি! কত টাকা?’

‘তা ঠিক জানি না। তবে মোটা টাকা।’

এই সময় সামনে ফট্‌ফট্‌ শব্দ শুনিয়া দেখিলাম একটি মোটর-বাইক আসিতেছে। আরও কাছে আসিলে চেনা গেল‌, আরোহী ডি.এস.পি. পুরন্দর পাণ্ডে। তিনিও আমাদের চিনিয়াছিলেন‌, মোটর-বাইক থামাইয়া সহাস্যমুখে অভিবাদন করিলেন।

কুশল প্রশ্ন আদান-প্রদানের পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ফাল্গুনী পাল আপনার ছবি এঁকেছে?’

পাণ্ডে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন‌, ‘তাজ্জব ব্যাপার মশাই‌, পর দিনই ছবি নিয়ে হাজির। একেবারে হুবহু ছবি এঁকেছে। অথচ আমার ফটো তার হাতে যাবার কোনই সম্ভাবনা নেই। সত্যি গুণী লোক; দশ টাকা খসাতে হল।’

ব্যোমকেশ সহস্যে বলিল‌, ‘কোথায় থাকে সে?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আর বলবেন না। অতবড় গুণী। কিন্তু একেবারে হতভাগা। পাঁড় নেশাখোর—মদ গাঁজা গুলি কোকেন কিছুই বাদ যায় না। মাসখানেক এখানে এসেছে। এখানে এসে যেখানে সেখানে পড়ে থাকত‌, কোনও দিন কারুর বারান্দায়‌, কোনও দিন কারুর খড়ের গাদায় রাত কাটাত। মহীধরবাবু্‌, দয়া করে নিজের বাগানে থাকতে দিয়েছেন। ওঁর বাগানের কোণে একটা মেটে ঘর আছে‌, দুদিন থেকে সেখানেই আছে।’

হতভাগ্য এবং চরিত্রহীন শিল্পীর যে-দশা হয় ফাল্গুনীরও তাঁহাই হইয়াছে। তবু কিছুদিনের জন্যও সে একটা আশ্রয় পাইয়াছে জানিয়া মনটা আশ্বস্ত হইল।

পাণ্ডে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিবার উপক্ৰম করিলে সোম বলিলেন‌, ‘আপনি এদিকে চলেছেন। কোথায়?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘মহীধরবাবুর বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। নকুলেশবাবুর মুখে শুনলাম তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই বাড়ি যাবার পথে তাঁর খবর নিয়ে যাব।’

‘কি অসুখ?’

‘সামান্য সর্দিকাশি। কিন্তু ওঁর হাঁপানির ধাত।’

সোম বলিলেন‌, ‘তাই তো‌, আমারও দেখতে যাওয়া উচিত। মহীধর বাবু আমাকে বড়ই স্নেহ করেন—’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘বেশ তো‌, আমার গাড়ির পিছনের সীটে উঠে বসুন না‌, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। ফেরবার সময় আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।’

‘তাহলে তো ভালই হয়।’ বলিয়া সোম মোটর-বাইকের পিছনে গদি-আঁটা আসনটিতে বসিয়া পাণ্ডের কোমর জড়াইয়া লইলেন।

0 Shares