ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা, মহীধর বাবুকে বলে দেবেন। আমরা কাল বিকেলে যাব।’
‘আচ্ছা! নমস্কার।’
মোটর-বাইক দুইজন আরোহী লইয়া চলিয়া গেল। আমরাও বাড়ির দিকে ফিরিলাম। লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশ আপন মনে মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতেছে।
বাড়ি ফিরিয়া চা পান করিতে বসিলাম। ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। দরজা খোলা ছিল; সিঁড়ির উপর ভারী পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চকিত হইয়া খাটো গলায় বলিল, ‘অধ্যাপক সোম কোথায় গেছেন এ প্রশ্নের যদি জবাব দেবার দরকার হয়, বলো তিনি মিস্টার পাণ্ডের বাড়িতে গেছেন।’
কথাটা ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই প্রশ্নের উত্তর দিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইল। মালতী দেবী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সর্দিতে তাঁহার মুখখানা আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষু রক্তাভ; তিনি ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সত্যবতী। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আসুন মিসেস সোম।’
মালতী দেবী ধরা-ধরা গলায় বলিলেন, ‘না, আমার শরীর ভাল নয়। উনি আপনাদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন, কোথায় গেলেন?’
ব্যোমকেশ দ্বারের কাছে আসিয়া সহজ সুরে বলিল, ‘রাস্তায় পাণ্ডে সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি প্রোফেসর সোমকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।’
মালতী দেবী বিস্ময়ভরে বলিলেন, ‘পুলিসের পাণ্ডে? ওঁর সঙ্গে তাঁর কি দরকার?’
ব্যোমকেশ সরলভাবে বলিল, ‘তা তো কিছু শুনলাম না। পাণ্ডে বললেন, চলুন আমার বাড়িতে চা খাবেন। হয়তো কোনও কাজের কথা আছে।’
মালতী দেবী আমাদের তিনজনের মুখ ভাল করিয়া দেখিলেন, একটা গুরুভার নিশ্বাস ফেলিলেন, তারপর আর কোনও কথা না বলিয়া উপরে চলিয়া গেলেন। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম।
‘ব্যোমকেশ আমাদের পানে চাহিয়া একটু লজ্জিতভাবে হাসিল, বলিল ‘ডাহা মিথ্যে কথা বলতে হল। কিন্তু উপায় কি? বাড়িতে দাম্পত্য-দাঙ্গা হওয়াটা কি ভাল?’
সত্যবতী বাঁকা সুরে বলিল, ‘তোমাদের সহানুভূতি কেবল পুরুষের দিকে। মিসেস সোম যে সন্দেহ করেন। সে নেহাত মিছে নয়।’
ব্যোমকেশের স্বর গরম হইয়া উঠিল, ‘আর তোমাদের সহানুভূতি কেবল মেয়েদের দিকে। স্বামীর ভালবাসা না পেলে তোমরা হিংসেয় চৌচির হয়ে যাও, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা কি করে রাখতে হয় তা জান না।—যাক, অজিত, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ভাই; বাইরের বারান্দায় পাহারা দিতে হবে। সোম ফিরলেই তাঁকে চেতিয়ে দেওয়া দরকার, নৈলে মিথ্যে কথা যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সোম তো যাবেই, সেই সঙ্গে আমাদেরও অশেষ দুৰ্গতি হবে।’
আমার কোনই আপত্তি ছিল না। বাহিরের বারান্দায় একটা চেয়ার পড়িয়া থাকিত, তাহাতে বসিয়া মনের সুখে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। বাহিরে একটু ঠাণ্ডা বেশি, কিন্তু আলোয়ান গায়ে থাকিলে কষ্ট হয় না।
সোম ফিরিলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। পাণ্ডের মোটর ফন্টু ফন্টু শব্দে ফটকের বাহিরে দাঁড়াইল, সোমকে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। তিনি বারান্দায় উঠিলে আমি বলিলাম, ‘শুনে যান। কথা আছে।’
বসিবার ঘরে ব্যোমকেশ একলা ছিল। সোমের মুখ দেখিলাম, গভীর ও কঠিন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘মহীধরবাবু কেমন আছেন?’
সোম সংক্ষেপে বলিলেন, ‘ভালই।’
‘ওখানে আর কেউ ছিল নাকি?’
‘শুধু ডাক্তার ঘটক।’
ব্যোমকেশ তখন মালতী-সংবাদ সোমকে শুনাইল। সোমের গম্ভীর মুখে একটু হাসি ফুটিল। তিনি বলিলেন, ‘ধন্যবাদ।’
৫
পরদিন প্ৰভাতে প্ৰাতরাশের সময় লক্ষ্য করিলাম দাম্পত্য কলহ কেবল বাড়ির উপরতলায় আবদ্ধ নাই, নীচের তলায় নামিয়া আসিয়াছে। সত্যবতীর মুখ ভারী, ব্যোমকেশের অধরে বঙ্কিম কঠিনতা। দাম্পত্য কলহ বোধ করি সর্দিকাশির মতাই ছোঁয়াচে রোগ।
কি করিয়া দাম্পত্য কলহের উৎপত্তি হয়, কেমন করিয়া তাহার নিবৃত্তি হয়, এসব গুঢ় রহস্য কিছু জানি না। কিন্তু জিনিসটা নূতন নয়, ইতিপূর্বে দেখিয়াছি। ঋষি-শ্ৰাদ্ধের ন্যায় মহা ধুমধামের সহিত আরম্ভ হইয়া অচিরাৎ প্রভাতের মেঘ-ডম্বরবৎ শূন্যে মিলাইয়া যাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।
আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, চল আজ সকালবেলা একটু বেরুনো যাক।’
বলিলাম, ‘বেশ, চল। সত্যবতী তৈরি হয়ে নিক।’
সত্যবতী বিরসমুখে বলিল, ‘আমার বাড়িতে কাজ আছে। সকাল বিকাল টো টো করে বেড়ালে চলে না।’
‘ব্যোমকেশ উঠিয়া শালটা গায়ে জড়াইতে জড়াইতে বলিল, ‘আমরা দু’জনে যাব এই প্রস্তাবই আমি করেছিলাম। চল, মিছে বাড়িতে বসে থেকে লাভ নেই।’
সত্যবতী ব্যোমকেশের পায়ের দিকে একটা কটাক্ষপাত করিয়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলিল, ‘যার রোগা শরীর তার মোজা পায়ে দিয়ে বাইরে যাওয়া উচিত।’ বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমি হাসি চাপিতে না পারিয়া বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলাম। কয়েক মিনিট পরে ব্যোমকেশ। বাহির হইয়া আসিল। তাহার ললাটে গভীর ভুকুটি, কিন্তু পায়ে মোজা।
রাস্তায় বাহির হইলাম। ব্যোমকেশের যে কোনও বিশেষ গন্তব্য স্থান আছে তাহা বুঝিতে পারি নাই! ভাবিয়ছিলাম হাওয়া বদলাকারীর স্বাভাবিক পরিব্ৰজনম্পূহয় তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। কিন্তু কিছু দূর যাইবার পর একটা খালি রিকশা দেখিয়া সে তাহাতে উঠিয়া বসিল। আমিও উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডেপুটি ঊষানাথবাবুক মোকাম চলো।’
রিকশা চলিতে আরম্ভ করিলে আমি বলিলাম, হঠাৎ ঊষানাথবাবু?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ রবিবার, তিনি বাড়ি থাকবেন। তাঁকে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।’