চিত্রচোর

আধ মাইল পথ চলিবার পর আমি বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, তুমি ছবি চুরিয়া ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ মনে হচ্ছে। সত্যিই কি ওতে গুরুতর কিছু আছে?’

সে বলিল‌, ‘সেইটেই আবিষ্কারের চেষ্টা করছি।’

আরও আধ মাইল পথ উত্তীর্ণ হইয়া ঊষানাথবাবুর বাড়িতে পৌঁছান গেল। হাকিম পাড়ায় বাড়ি‌, পাঁচিল দিয়া ঘেরা। ফটকের কাছে রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

প্রথমেই চমক লাগিল‌, বাড়ির সদরে কয়েকজন পুলিসের লোক দাঁড়াইয়া আছে। তারপর দেখিলাম ডি.এস.পি‌, পুরন্দর পাণ্ডের মোটর-বাইক রহিয়াছে।

উদ্যানাথ ও পাণ্ডে সদর বারান্দায় ছিলেন। আমাদের দেখিয়া পাণ্ডে সবিস্ময়ে বলিলেন‌, ‘একি‌, আপনারা!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ রবিবার‌, তাই বেড়াতে এসেছিলাম।’

ঊষানাথ হিমশীতল হাসিয়া বলিলেন‌, ‘আসুন। কাল রাত্রে বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে।’

‘তাই নাকি? কি চুরি গেছে?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সেটা এখনও জানা যায়নি। রাত্রে এঁরা দোতলায় শোন‌, নীচে কেউ থাকে না। ঘর বন্ধ থাকে। কাল রাত্রে আপিস-ঘরে চোর ঢুকে আলমারি খোলবার চেষ্টা করেছিল। একটা পার-চাবি তালায় ঢুকিয়েছিল‌, কিন্তু সেটা বের করতে পারেনি।’

‘বটে। আলমারিতে কি ছিল?’

ঊষানাথবাবু বলিলেন‌, ‘সরকারী দলিলপত্র ছিল‌, আর আমার স্ত্রীর গয়নার বাক্স ছিল। স্টিলের আলমারি। লোহার সিন্দুক বলতে পারেন।’

ঊষানাথবাবুর চোখে কালো চশমা‌, চোখ দেখা যাইতেছে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয়‌, তিনি ভয় পাইয়াছেন। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে চোর কিছু নিয়ে যেতে পারেনি?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সেটা আলমারি না খোলা পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। একটা চাবিওয়ালা ডাকতে পাঠিয়েছি।’

‘হুঁ। চোর ঘরে ঢুকল কি করে?’

‘কাচের জানালার একটা কাচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে ছিটিকিনি খুলেছে। আসুন না দেখবেন।’

ঊষানাথবাবুর আপিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম। মাঝারি আয়তনের ঘর‌, একটা টেবিল‌, কয়েকটা

কাচ-ভাঙা জানালা পরীক্ষা করিল; আলমারির চাবি ঘুরাইবার চেষ্টা করিল‌, কিন্তু চাবি ঘুরিল না। এই চাবিটা ছাড়া চোর নিজের আগমনের আর কোনও নিদর্শন রাখিয়া যায় নাই। আপিস-ঘরের পাশেই ড্রয়িং-রুম‌, মাঝে দরজা। আমরা সেখানে গিয়া বসিলাম। আলমারিটা খোলা না হওয়া‌, পর্যন্ত কিছু চুরি গিয়াছে কিনা জানা যাইবে না। ঊষানাথবাবু চায়ের প্রস্তাব করিলেন‌, আমরা মাথা নাড়িয়া প্ৰত্যাখ্যান করিলাম।

ড্রয়িং-রুমটি মামুলিভাবে সাজানো গোছানো। এখানেও দেওয়ালে ভারত-সম্রাটের ছবি। এক কোণে একটি রেডিও যন্ত্র। চেয়ারগুলির পাশে ছোট ছোট নীচু টেবিল; তাঁহাদের কোনটার উপর পিতলের ফুলদানী‌, কোনটার উপর ছবির অ্যালবাম; দামী জিনিস কিছু নাই।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চোর বোধ হয় এ ঘরে ঢোকেনি।’

ঊষানাথবাবু বলিলেন‌, ‘এ ঘরে চুরি করবার মত কিছু নেই।’ বলিয়াই তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। চোখের কালো চশমা ক্ষণেকের জন্য তুলিয়া কোণের রেডিও-যন্ত্রটার দিকে চাহিয়া রহিলেন‌, তারপর চশমা নামাইয়া বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আমার পরী! পরী কোথায় গেল!’

আমরা সমস্বরে বলিলাম‌, ‘পরী!’

ঊষানাথবাবু রেডিওর কাছে গিয়া এদিক-ওদিক দেখিতে দেখিতে বলিলেন‌, ‘একটা রূপোলী গিলটি-করা ছোট্ট পরী—ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের স্ত্রী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন–সেটা রেডিওর ওপর রাখা থাকত। নিশ্চয় চোরে নিয়ে গেছে।’ আমরাও উঠিয়া গিয়া দেখিলাম। রেডিও যন্ত্রের উপর আধুলির মত একটা স্থান সম্পূর্ণ শূন্য। পরী ঐ স্থানে অবস্থান করিতেন সন্দেহ নাই।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চোর হয়তো নেয়নি। আপনার ছেলে খেলা করবার জন্যে নিয়ে থাকতে পারে। একবার খোঁজ করে দেখুন না।’

ঊষানাথবাবু ভ্রূ-কুঞ্চন করিয়া বলিলেন‌, ‘খোকা সভ্য ছেলে‌, সে কখনও কোনও জিনিসে হাত দেয় না। যা হোক‌, আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ পাণ্ডেকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কাউকে সন্দেহ করেন নাকি?

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সন্দেহ-না‌, সে রকম কিছু নয়। তবে একটা আরদালি বলছে‌, কাল রাত্রি আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় একটা পাগলাটে গোছের লোক ডেপুটিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ডেপুটিবাবু দেখা করেননি‌, আরদালি বাইরে থেকেই তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। আরদালি লোকটার যে-রকম বর্ণনা দিলে তাতে তো মনে হয়–’

‘ফাল্গুনী পাল?’

‘হ্যাঁ। একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছি।’

ঊষানাথবাবুর উপর হইতে নামিয়া আসিয়া জানাইলেন তাঁহার স্ত্রী-পুত্র পরীর কোনও খবরই রাখেন না। নিশ্চয় চোর আর কিছু না পাইয়া রৌপ্যভ্রমে পরীকে লইয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঁচকাইয়া বসিয়া ছিল‌, মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ভাল কথা‌, সেই ছবিটা আছে কিনা দেখেছিলেন কি?’

‘কোন ছবি?

‘সেই যে একটা গ্রুপ-ফটোর কথা মহীধরবাবুর বাড়িতে হয়েছিল?’

‘ও-না‌, দেখা হয়নি। ঐ যে আপনার পাশে অ্যালবাম রয়েছে‌, দেখুন না ওতেই আছে।’

ব্যোমকেশ অ্যালবাম লইয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে লাগিল। তাহাতে ঊষানাথবাবুর পিতা মাতা‌, ভাই ভগিনী‌, স্ত্রী পুত্ৰ সকলের ছবি আছে‌, এমন কি মহীধরবাবু ও রজনীর ছবিও আছে‌, কেবল উদ্দিষ্ট গ্রুপ-ফটোখানি নাই!

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কৈ‌, দেখছি না তো?’

‘নেই।’ ঊষানাথবাবু উঠিয়া আসিয়া নিজে অ্যালবাম দেখিলেন‌, কিন্তু ফটো পাওয়া গেল না। তিনি তখন বলিলেন‌, ‘কি জানি কোথায় গেল। কিন্তু এটা এমন কিছু দামী জিনিস নয়। আলমারি থেকে যদি দলিলপত্র কিংবা গয়নার বাক্স চুরি গিয়া থাকে—’

0 Shares