চিড়িয়াখানা

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা। গ্ৰীষ্মকাল। ব্যোমকেশের শ্যালক সুকুমার সত্যবতীকে ও খোকাকে লইয়া দাৰ্জিলিং গিয়াছে। ব্যোমকেশ ও আমি হ্যারিসন রোডের বাসায় পড়িয়া চিংড়িপোড়া হইতেছি।

ব্যোমকেশের কাজকর্মে মন্দা যাইতেছিল। ইহা তাহার পক্ষে এমন কিছু নূতন কথা নয়; কিন্তু এবার নৈষ্কর্মের দৈর্ঘ্য ও নিরবচ্ছিন্নতা এতাই বেশি যে আমাদের অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। উপরন্তু খোকা ও সত্যবতী গৃহে নাই। মরিয়া হইয়া আমরা শেষ পর্যন্ত দাবা খেলিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম।

আমি মোটামুটি দাবা খেলিতে জানিতাম‌, ব্যোমকেশকে শিখাইয়াছিলাম। প্রথম প্রথম সে সহজেই হারিয়া যাইত; ক্রমে তাহাকে মাত করা কঠিন হইল। অবশেষে একদিন আসিল যেদিন সে বড়ের কিস্তিতে আমাকে মাত করিয়া দিল।

পুত্ৰাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ে গৌরবের হানি হয় না জানি। কিন্তু যাহাকে মাত্র কয়েকদিন আগে হাতে ধরিয়া দাবার চাল দিতে শিখাইয়াছি‌, তাহার কাছে হারিয়া গেলে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপর সন্দেহ হয়। আমার চিত্তে আর সুখ রহিল না।

তার উপর এবার গরমও পড়িয়াছে প্ৰচণ্ড। সেই যে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি একদিন গলদঘর্ম হইয়া সকালে ঘুম ভাঙিয়াছিল‌, তারপর এই দেড় মাস ধরিয়া গরম উত্তরোত্তর বাড়িয়াই চলিয়াছে। মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি যে হয় নাই এমন নয়‌, কিন্তু তাহা হবিষা কৃষ্ণবর্ক্সেব তাপের মাত্রা বর্ধিত করিয়াছিল। দিবারাত্র ফ্যান চালাইয়াও নিস্কৃতি ছিল না‌, মনে হইতেছিল। সারা গায়ে রসগোল্লার রস মাখিয়া বসিয়া আছি।

দেহমনের এইরূপ নিরাশাজনক অবস্থা লইয়া একদিন পূবাঁহুে তক্তপোশের উপর দাবার ছক পাতিয়া বসিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ আমাকে গজ-চক্ৰ করিবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করিয়া শুনেিয়ছে‌, আমি অতিমাত্রায় বিচলিত হইয়া অনর্গল ঘৰ্মত্যাগ করতেছি‌, এমন সময় বাধা দরজায় খুঁটু খুঁটু কড়া নাড়ার শব্দ। ডাকপিয়ন নয়‌, তাহার কড়া নাড়ার ভঙ্গীতে একটা বেপরোয়া উগ্ৰতা আছে। তবে কে? আমরা ব্যগ্র আগ্রহে পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। এতদিন পরে সত্যই কি নূতন রহস্যের শুভাগমন হইল।

ব্যোমকেশ টপ করিয়া পাঞ্জাবিটা গলাইয়া লইয়া দ্রুত গিয়া দ্বার খুলিল। আমি ইতিমধ্যে নিরাবরণ দেহে একটা উড়ানি চাদর জড়াইয়া ভদ্র হইয়া বসিলাম।

দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন মধ্যবয়স্ক একটি ভদ্রলোক। আকৃতি মধ্যম‌, একটু নিরেট গোছের‌, চাঁচা-ছোলা ধারালো মুখ‌, চোখে ফ্রেমহীন ধূমল কাচের চশমা। পরিধানে মরাল-শুভ্র প্যান্টুলুন ও সিন্ধের হাতকটা কামিজ। পায়ে মোজা নাই‌, কেবল বিননি-করা চামড়ার গ্ৰীসান স্যান্ডাল। ছিমছাম চেহারা।

মার্জিত কণ্ঠে বলিলেন,–’ব্যোমকেশবাবু—?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আমিই। —আসুন!’

সে ভদ্রলোকটিকে আনিয়া চেয়ারে বসাইল‌, মাথার উপর পাখাটা জোর করিয়া দিল। ভদ্রলোক একটি কার্ড বাহির করিয়া ব্যোমকেশকে দিলেন।

কার্ডে ছাপা ছিল–

নিশানাথ সেন
গোলাপ কলোনী
মোহনপুর‌, ২৪ পরগনা
বি. এ. আর

কার্ডের অন্য পিঠে টেলিগ্রামের ঠিকানা ‘গোলাপ’ এবং ফোন নম্বর।

ব্যোমকেশ কার্ড হইতে চোখ তুলিয়া বলিল,–’গোলাপ কলোনী। নামটা নতুন ধরনের মনে হচ্ছে–’

নিশানাথবাবুর মুখে একটু হাসির ভাব দেখা দিল‌, তিনি বলিলেন,–’গোলাপ কলোনী আমার ফুলের বাগান। আমি ফুলের ব্যবসা করি। শাকসবজিও আছে‌, ডেয়ারি ফার্মও আছে। নাম দিয়েছি গোলাপ কলোনী।’

ব্যোমকেশ তাঁহাকে তীক্ষ্ণ চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, —’ও।–মোহনপুর কলকাতা থেকে কত দূর?’

নিশানাথ বলিলেন,–’শিয়ালদা থেকে ঘন্টাখানেকের পথ–তবে রেলওয়ে লাইনের ওপর পড়ে না। স্টেশন থেকে মাইল দুই দূরে।’

নিশানাথবাবুর কথা বলিবার ভঙ্গীটি ত্বরাহীন‌, যেন আলস্যভরে কথা বলিতেছেন। কিন্তু এই মন্থরতা যে সত্যই আলস্য বা অবহেলা নয়‌, বরং তাঁহার সাবধানী মনের বাহ্য আবরণ মাত্র‌, তাহা তাঁহার সজাগ সতর্ক মুখ দেখিয়া বোঝা যায়। মনে হয় দীর্ঘকাল বাক-সংযমের ফলে তিনি এইরূপ বাচনভঙ্গীতে অভ্যস্ত হইয়াছেন।

ব্যোমকেশের বাকপ্ৰণালীও অতিথির প্রভাবে একটু চিন্তা-মন্থর হইয়া গিয়াছিল‌, সে ধীরে ধীরে বলিল,–’আপনি বলছেন ব্যবসা করেন। আপনাকে কিন্তু ব্যবসাদার বলে মনে হয় না‌, এমন কি বিলিতি সওদাগরি অফিসের ব্যবসাদারও নয়। আপনি কতদিন এই ব্যবসা করছেন?’

নিশানাথ বললেন–দশ বছরের কিছু বেশি। —আমাকে আপনার কী মনে হয়‌, বলুন দেহকি।

‘মনে হয় আপনি সিভিলিয়ান ছিলেন। জজ কিম্বা ম্যাজিস্ট্রেট।’

ধোঁয়াটে চশমার আড়ালে নিশানাথবাবুর চোখ দু’টি একবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। কিন্তু তিনি শান্ত-মন্থর কঠেই বলিলেন,–’কি করে আন্দাজ করলেন জানি না। আমি সত্যিই বোম্বাই প্রদেশের বিচার বিভাগে ছিলাম‌, সেশন জজ পর্যন্ত হয়েছিলাম। তারপর অবসর নিয়ে এই দশ বছর ফুলের চাষ করছি।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’মাফ করবেন‌, আপনার এখন বয়স কত?’

‘সাতান্ন চলছে।’

‘তার মানে সাতচল্লিশ বছর বয়সে রিটায়ার করেছেন। যতদূর জানি সরকারী চাকরির মেয়াদ পঞ্চান্ন বছর পর্যন্ত।’

নিশানাথবাবু একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন,–’আমার ব্লাড-প্রেসার আছে। দশ বছর আগে তার সূত্রপাত হয়। ডাক্তারেরা বললেন মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ করতে হবে‌, নইলে বাঁচব না। কাজ থেকে অবসর নিলাম। তারপর বাংলা দেশে এসে ফুলের ফসল ফলাচ্ছি। ভাবনা-চিন্তা কিছু নেই‌, কিন্তু রক্তের চাপ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই যাচ্ছে।’

0 Shares