চিড়িয়াখানা

পাশ দিয়া যাইবার সময় ভাঙা দরজা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম‌, ভিতরে কয়েকটা ধূলিধূসর বেঞ্চি পড়িয়া আছে। মেঝের উপর কতকগুলি মাটিভরা চ্যাঙারি রহিয়াছে‌, তাহাতে নবাকুরিত গাছের চারা।

এখান হইতে সম্মুখের সীমানার সমান্তরাল খানিক দূর অগ্রসর হইবার পর গোেহালের কাছে উপস্থিত হইলাম। চেঁচারির বেড়া দিয়া ঘেরা অনেকখানি জমি‌, তাহার পিছন দিকে লম্বা খড়ের চালা; চালার মধ্যে অনেকগুলি গরু-বাছুর বাঁধা রহিয়াছে। খোলা বাথানে খড়ের আটটি ডাঁই করা।

গোহালের ঠিক গায়ে একটি ক্ষুদ্র টালি-ছাওয়া কুঠি। আমরা গোহালের সম্মুখে উপস্থিত হইলে একটি লম্বা-চওড়া যুবক কুঠির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিল। গায়ে গেঞ্জি, হাঁটু পর্যন্ত কাপড়; দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

যুবকের দেহ বেশ বলিষ্ঠ কিন্তু মুখখানি বোকাটে ধরনের। আমাদের কাছে আসিয়া সে দুই কানের ভিতর হইতে খানিকটা তুলা বাহির করিয়া ফেলিল এবং আমাদের পানে চাহিয়া হাবলার মত হাসিতে লাগিল। হাসি কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব হাসি‌, গলা হইতে কোনও আওয়াজ বাহির হইতে শুনিলাম না।

নিশানাথ বলিলেন,–’এর নাম পানু। গো-পালন করে তাই ওকে পানুগোপাল বলা হয়। কানে কম শোনে।’

পানুগোপাল পূর্ববৎ হাসিতে লাগিল‌, সে নিশানাথবাবুর কথা শুনিতে পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। নিশানাথবাবু একটু গলা চড়াইয়া বলিলেন,–’পানুগোপাল‌, তোমার গরু-বাছুরের খবর কি? সব ভাল তো?’

প্ৰত্যুত্তরে পানুগোপালের কণ্ঠ হইতে ছাগলের মত কম্পিত মিহি আওয়াজ বাহির হইল। চমকিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া দেখিলাম সে প্ৰাণপণে কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে‌, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না। নিশানাথবাবু হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিলেন‌, খাটো গলায় বলিলেন,–’পানু যে একেবারে কথা বলতে পারে না তা নয়‌, কিন্তু একটু উত্তেজিত হলেই কথা আটকে যায়। ছেলেটা ভাল‌, কিন্তু ভগবান মেরেছেন।’

অতঃপর আমরা আবার অগ্রসর হইলাম‌, পানুগোপাল দাঁড়াইয়া রহিল। কিছু দূর গিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম পানুগোপাল আবার কানে তুলা গুঁজিতেছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’পানুগোপাল কানে তুলো গোঁজে কেন?’

নিশানাথ বলিলেন,–’কানে পুঁজ হয়।’

কিছুদূর চলিবার পর বাঁ দিকে রাস্তার একটা শাখা গিয়াছে দেখিলাম; রাস্তাটি নিশানাথবাবুর বাড়ির পিছন দিক দিয়া গিয়াছে‌, মাঝে পাতা—বাহার ক্রোটন গাছে ভরা জমির ব্যবধান। এই রাস্তার মাঝামাঝি একটি লম্বাটে গোছের বাড়ি। নিশানাথবাবু সেই দিকে মোড় লইয়া বলিলেন,–’চলুন‌, আমাদের রান্নাঘর খাবারঘর দেখবেন।’

পূর্বে শুনিয়াছি মুকুল নামে একটি মেয়ে কলোনীর রান্নাবান্না করে। অনুমান করিলাম মুকুলকে দেখাইবার জন্যই নিশানাথবাবু আমাদের এদিকে লইয়া যাইতেছেন।

ভোজনালয়ে উপস্থিত হইয়া দেখা গেল‌, একটি লম্বা ঘরকে তিন ভাগ করা হইয়াছে; একপাশে রান্নাঘর‌, মাঝখানে আহারের ঘর এবং অপর পাশে স্নানাদির ব্যবস্থা। রান্নাঘর হইতে ছ্যাকছোঁক শব্দ আসিতেছিল‌, নিশানাথবাবু সে দিকে চলিলেন।

আমাদের সাড়া পাইয়া দয়মন্তী দেবী রান্নাঘরের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন; কোমরে আঁচল জড়ানো‌, হাতে খুন্তি। তাঁহাকে এই নূতন পারিবেশের মধ্যে দেখিয়া মনে হইল‌, আগে যাঁহাকে দেখিয়াছিলাম ইনি সে-মানুষ নন‌, সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। প্রথমে দূর হইতে দেখিয়া একরকম মনে হইয়াছিল‌, তারপর সরবতের ট্রে হাতে তাঁহার অন্যরূপ আকৃতি দেখিয়াছিলাম‌, এখন আবার আর এক রূপ। কিন্তু তিনটি রূপই প্ৰীতিকর।

দময়ন্তী দেবী একটু উৎকণ্ঠিতভাবে স্বামীর মুখের পানে চাহিলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’তুমি রান্না করছি? মুকুল কোথায়?’

দময়ন্তী দেবী বলিলেন,–’মুকুলের বড় মাথা ধরেছে‌, সে রান্না করতে পারবে না। শুয়ে আছে।’

নিশানাথ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, —’তাহলে বনলক্ষ্মীকে ডেকে পাঠাওনি কেন? সে তোমাকে যোগান দিতে পারত।’

দময়ন্তী বলিলেন,–’দরকার নেই‌, আমি একলাই সামলে নেব।’

নিশানাথের ভ্রূকুঞ্চিত হইয়া রহিল‌, তিনি আর কিছু না বলিয়া ফিরিলেন। এই সময় স্নানঘরের ভিতর হইতে একটি যুবক তোয়ালে দিয়া মাথা মুছতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল,–’কাকিমা‌, শীগগির শীগগির-এখনি কলকাতা যেতে হবে–এই পর্যন্ত বলিবার পর সে তোয়ালে হইতে মুখ বাহির করিয়া আমাদের দেখিয়া থামিয়া গেল।

দময়ন্তী বলিলেন,–’আসন‌, পেতে বোসো‌, ভাত দিচ্ছি। সব রান্না কিন্তু হয়নি এখনও।’ তিনি রান্নাঘরের মধ্যে অদৃশ্য হইলেন।

আমাদের সম্মুখে যুবক মানসিক্ত নগ্নদেহে বিশেষ অপ্ৰস্তুত হইয়া পড়িয়াছিল‌, সে তোয়ালে গায়ে জড়াইয়া আসন পাতিতে প্ৰবৃত্ত হইল। তাহার বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ-সাতাশ‌, বলবান সুদৰ্শন চেহারা। নিশানাথ অপ্ৰসন্নভাবে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন,–’বিজয়‌, তুমি এখনও কাজে যাওনি?

বিজয় কাঁচুমাচু হইয়া বলিল,–’আজ দেরি হয়ে গেছে কাকা।–হিসেবটা তৈরি করছিলাম–

নিশানাথ জিজ্ঞাসা করিলেন,–’হিসেব কতদূর?’

‘আর দু’তিন দিন লাগবে।’

ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া নিশানাথ দ্বারের দিকে চলিলেন‌, আমরা অনুবর্তী হইলাম। হিসাব লইয়া গোলাপ কলোনীতে একটা গোলযোগ পাকাইয়া উঠিতেছে মনে হইল।

দ্বারের নিকট হইতে পিছন ফিরিয়া দেখি, বিজয় বিস্ময়-কুতূহলী চক্ষে আমাদের পানে তাকাইয়া আছে। আমার সহিত চোখাচোখি হইতে সে ঘাড় নিচু করিল।

বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ নিশানাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,–’আপনার ভাইপো? উনিই বুঝি ফুলের দোকান দেখেন?’

0 Shares