চিড়িয়াখানা

‘হ্যাঁ।‘

রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে নিশানাথবাবুকে প্রশ্ন করিলাম,–’আচ্ছা‌, নেপালবাবুরা কতদিন হল এখানে এসেছেন?’

নিশানাথ বলিলেন,–’প্রায় দু’বছর আগে। এক-আধ মাস কম হতে পারে।’

মনে মনে নোট করিলাম‌, সুনয়না প্রায় ঐ সময় কলিকাতা হইতে নিরুদ্দেশ হইয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিলাম,–’ঠিক ঠিক সময়টা মনে নেই?’

নিশানাথ চিন্তা করিয়া বলিলেন,–’দু’বছর আগে‌, বোধহয় সেটা জুলাই মাস। মনে আছে‌, আমার স্ত্রী লেখাপড়া ছেড়ে দেবার দু-তিন দিন পরেই ওরা এসেছিল।’

‘আপনার স্ত্রী-লেখাপড়া–’

‘আমার স্ত্রীর মাঝে লেখাপড়া আর বিলিতি আদবাকায়দা শেখাবার শখ হয়েছিল। মাস আষ্ট্রেক-দশ নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত করেছিলেন‌, একটা‌, বিলিতি মেয়ে-স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোষালো না। উনি স্কুল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি এসে বসবার দু-তিন দিন পরে নেপালবাবু মুকুলকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।’

সংবাদটি হজম করিয়া পূর্ব-প্রসঙ্গে ফিরিয়া গেলাম্‌,–’নেপালীবাবু কলোনীর কোন কাজ করেন?

নিশানাথ অম্লতিক্ত হাসিলেন,–’বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন‌, দাবা খেলেন‌, আর সব কাজে আমার খুঁত ধরেন।’

‘আপনার খুঁত ধরেন?’

‘হ্যাঁ‌, আমি যে-ভাবে কলোনীর কাজ চালাই ওঁর পছন্দ হয় না। ওঁর বিশ্বাস‌, ওঁর হাতে পরিচালনার ভার দিলে ঢের ভাল চালাতে পারেন।’

‘উনি তাহলে কোনও কাজই করেন না?’

একটু নীরব থাকিয়া নিশানাথ বলিলেন,–’মুকুল খুব কাজের মেয়ে।’

মুকুল কাজের মেয়ে হইতে পারে; পিতার নৈষ্কর্ম সে নিজের পরিশ্রম দিয়া পুরাইয়া দেয়। কিন্তু আমরা আসিব শুনিয়া তাহার মাথা ধরিল কেন? এবং জানোলা দিয়া লুকাইয়া আমাদের পর্যবেক্ষণ করিবারই বা তাৎপৰ্য কি?

মোড়ের কাছে আসিয়া পৌঁছিলাম। সামনে পিছনে রাস্তা চলিয়া গিয়াছে‌, রাস্তার ধারে দূরে দূরে কয়েকটি কুঠি (নক্সা পশ্য)। কুঠিগুলির ব্যবধানস্থল পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে গোলাপ ও অন্যান্য ফুলের গাছ। প্রচুর জলসিঞ্চন সত্ত্বেও ফুলগাছগুলি মুহ্যমান।

মোড়ের উপর দাঁড়াইয়া নিশানাথ পিছনের কুঠির দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিলেন,–’সবশেষের কুঠিতে রসিক থাকে। তার এদিকের কুঠি ব্ৰজদাসের। ঐ যে ব্ৰজদ্দাস বারান্দায় বসে কি করছে।’

তিনি সেইদিকে আগাইয়া গেলেন,–’কি হে ব্ৰজদাস‌, কি হচ্ছে?’

কুঠির বারান্দায় একটি প্রবীণ ব্যক্তি মাটিতে বসিয়া একটা হামানদিস্তা দুই পায়ে ধরিয়া কিছু কুটিতেছিলেন। বেঁটে গোলগাল লোকটি‌, মাথায় পাকা চুলের বাবরি‌, গলায় কঠি‌, কপালে হরিচন্দনের তিলক। নিশানাথের গলা শুনিয়া তিনি সসন্ত্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং হাস্যমুখে বলিলেন,–’একটা গরু রুগিয়েছে‌, তার জন্যে জোলাপ তৈরি করছি–নিমের পাতা‌, তিলের খোল আর এন্ডির বিচি।’

‘বেশ বেশ। যদি পারো প্রফেসার গুপ্তকে একটু খাইয়ে দিও‌, উপকার হবে।’ বলিয়া নিশানাথ ফিরিয়া চলিলেন।

বৈষ্ণব ব্ৰজদাস মিটমিটি হাসিতে হাসিতে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার চক্ষু দু’টি কিন্তু বৈষ্ণবোচিত ভাবাবেশে ঢুলু ঢুলু নয়‌, বেশ সজাগ এবং সতর্ক। দুইজন আগন্তুককে দেখিয়া তাঁহার চক্ষে যে জিজ্ঞাসা জাগিয়া উঠিল। তাহা তিনি মুখে প্রকাশ করিলেন না। নিশানাথও পরিচয় দিলেন না।

ফিরিয়া চলিতে চলিতে নিশানাথ বলিলেন,–’ব্ৰজদাস চিরকাল বৈষ্ণব ছিল না। ও বৈষ্ণব হয়ে গরু-বাছুরগুলোর ভারী সুখ হয়েছে। বড় যত্ন করে‌, গো-বদ্যির কাজও শিখেছে। গো-সেবা বৈষ্ণবের ধর্ম কিনা।’

নিশানাথবাবুর কথার মধ্যে একটু শ্লেষের ছিটা ছিল। প্রশ্ন করিলাম,–’উনি বৈষ্ণব হওয়ার আগে কী ছিলেন?’

নিশানাথ বলিলেন,–’জজ-সেরেস্তার কেরানি। ওকে অনেকদিন থেকে জানি। মাইনে বেশি। পেত না কিন্তু গান-বাজনা ফুর্তির দিকে ঝোঁক ছিল। সেরেস্তার কেরানিরা উপরি টাকাটা সিকেটা নিয়েই থাকে। কিন্তু ব্ৰজদাস একবার একটা গুরুতর দুষ্কার্য করে বসল। ঘুষ নিয়ে দপ্তর থেকে একটা জরুরী দলিল সরিয়ে ফেলল।’

‘তারপর?’

‘তারপর ধরা পড়ে গেল। ঘটনাচক্ৰে আমিই ওকে ধরে ফেললাম। আদালতে মামলা উঠল‌,’ আমাকে সাক্ষী দিতে হল। ছ’বছরের জন্যে ব্ৰজদাস শ্ৰীঘর গেল। ইতিমধ্যে আমি চাকরি ছেড়ে কলোনী নিয়ে পড়েছি‌, জেল থেকে বেরিয়ে ব্ৰজদাস সটান এখানে এসে উপস্থিত। দেখলাম‌, একেবারে বদলে গেছে; জেলের লাপসি খেয়ে খাঁটি বৈষ্ণব হয়ে উঠেছে। আমি সাক্ষী দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলাম। সেজন্যে আমার ওপর রাগ নেই। বরং কৃতজ্ঞতায় গদগদ। সেই থেকে আছে।’

বলিলাম,–’বৃদ্ধ বেশ্যা তপস্বিনী।’

নিশানাথ একটু নীরব থাকিয়া বলিলেন,–’ঠিক তাও নয়। ওর মনের একটা পরিবর্তন হয়েছে। আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বলছি না। তবে লক্ষ্য করেছি ও মিথ্যে কথা বলে না।’

কথা বলিতে বলিতে আমরা আর একটা কুঠির সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিয়ছিলাম‌, শুনিতে পাইলাম কুঠির ভিতর হইতে মৃদু সেতারের আওয়াজ আসিতেছে। আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে নিশানাথ বলিলেন,–’ডাক্তার ভুজঙ্গাধর। ওর সেতারের শখ আছে।’

রমেনবাবু একাগ্ৰ মনে শুনিয়া বলিলেন,–’খাসা হাত। গৌড়-সারঙ বাজাচ্ছেন।’

ডাক্তার ভূজঙ্গধর বোধহয় জানোলা দিয়া আমাদের দেখিতে পাইয়াছিলেন‌, সেতারের বাজনা থামিয়া গেল। তিনি বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন‌, বলিলেন,–’একি মিস্টার সেন‌, রোদুরে দাঁড়িয়ে কেন? রোদ লাগিয়ে ব্লাড-প্রেসার বাড়াতে চান?’

ডাক্তার ভুজঙ্গাধরের বয়স আন্দাজ চল্লিশ‌, দৃঢ় শরীর‌, ধারালো মুখ। মুখের ভাব একটু ব্যঙ্গ-বঙ্কিম; যেন বুদ্ধির ধার সিধা পথে যাইতে না পাইয়া বিদ্যুপের বাঁকা পথ ধরিয়াছে।

0 Shares