চিড়িয়াখানা

নিশানাথ বলিলেন,–’এদের বাগান দেখাচ্ছি।’

ডাক্তার বলিলেন,–’বাগান দেখাবার এই সময় বটে। তিনজনেরই সর্দিগমি হবে তখন হ্যাপা সামলাতে হবে এই নাম-কাটা ডাক্তারকে।’

‘না‌, আমরা এখনি ফিরব। কেবল বনলক্ষ্মীকে একবার দেখে যাব।’

ডাক্তার বাঁকা হাসিয়া বলিলেন,–’কোন বলুন দেখি? বনলক্ষ্মী বুঝি আপনার বাগানের একটি দর্শনীয় বস্তু‌, তাই এদের দেখাতে চান?’

নিশানাথ সংক্ষেপে বলিলেন,–’সেজন্যে নয়‌, অন্য দরকার আছে।’

‘ও—তাই বলুন—তা ওকে ওর ঘরেই পাবেন বোধহয়। এত রোদূরে সে বেরুবে না‌, ননীর অঙ্গ গলে যেতে পারে।’

‘ডাক্তার‌, তুমি বনলক্ষ্মীকে দেখতে পার না কেন বল দেখি?’

ডাক্তার একটু জোর করিয়া হাসিলেন,–’আপনারা সকলেই তাকে দেখতে পারেন‌, আমি দেখতে না পারলেও তার ক্ষতি নেই।–সে। যাক‌, আপনার আবার রক্তদান করবার সময় হল। আজ বিকেলে আসব নাকি ইনজেকশনের পিচকিরি নিয়ে?

‘এখনো দরকার বোধ করছি না।’ বলিয়া নিশানাথ চলিতে আরম্ভ করিলেন।

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’রক্তদানের কথা কি বললেন ডাক্তার?’

নিশানাথ বলিলেন,–’ব্লাড-প্রেসারের জন্যে আমি ওষুধ-বিষুধ বিশেষ খাই না‌, চাপ বাড়লে ডাক্তার এসে সিরিঞ্জ দিয়ে খানিকটা রক্ত বার করে দেয়। সেই কথা বলছিলাম। প্রায় মাসখানেক রক্ত বার করা হয়নি।’

এই সময় ব্যোমকেশ পিছন হইতে আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। নিশানাথ অবাক হইয়া বলিলেন,–’এ কি! এরি মধ্যে খেলা শেষ হয়ে গেল?’

ব্যোমকেশের মুখ বিমর্ষ। সে বলিল,–’নেপালবাবু লোকটি অতি ধূর্ত এবং ধড়িবাজ।’

‘কী হয়েছে?’

‘কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করছে কিছু বুঝতেই দিল না। তারপর যখন বুঝলাম তখন উপায়। নেই। মাত হয়ে গেলাম।’

আমরা হাসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, —’হাসি নয়। নেপালাবাবুকে দেখে মনে হয় হোৎকা‌, কিন্তু আসলে একটি বিচ্ছু।’

আমরা আবার হাসিলাম। ব্যোমকেশ তখন এই অরুচিকর প্রসঙ্গ পাল্টাইবার জন্য বলিল,–’পিছনের কুঠির বারান্দায় যাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম উনি কে?’

‘উনি ভুতপূর্ব ডাক্তার ভুজঙ্গধর দাস।’

‘উনি এখানে কদিন আছেন?’

‘প্ৰায় বছর চারেক হতে চলল।’

‘বরাবর এইখানেই আছেন?’

‘হ্যাঁ। মাঝে মাঝে দু’চার দিনের জন্যে ডুব মারেন‌, আবার ফিরে আসেন।’

‘কোথায় যান?’ ‘তা জানি না। কখনও জিগ্যেস করিনি‌, উনিও বলেননি।’

এতক্ষণে আমরা বনলক্ষ্মীর কুঠির সামনে উপস্থিত হইলাম। ইহার পর কলোনীর সম্মুখভাগে কেবল একটি কুঠি‌, সেটি বিজয়ের (নক্সা পশ্য)। আমাদের উদ্যান পরিক্রম প্রায় সম্পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে।

নিশানাথবাবু বারান্দার দিকে পা বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। ভিতর হইতে একটি মেয়ে বাহির হইয়া আসিতেছে; তাহার বাম বাহুর উপর কোঁচানো শাড়ি এবং গামছা‌, মাথার চুল খোলা। সহসা আমাদের দেখিয়া সে জড়সড়ভাবে দাঁড়াইল এবং ডান কাঁধের উপর কাপড় টানিয়া দিল। দেখিলে বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে সে স্নান করিতে যাইতেছে।

নিশানাথবাবু একটু অপ্রতিভ হইয়া সেই কথাই বলিলেন,–’বনলক্ষ্মী‌, তুমি স্নান করতে যাচ্ছ। আজ এত দেরি যে?’

বনলক্ষ্মী মুখ নীচু করিয়া বলিল,–’অনেক সেলাই বাকি পড়ে গিছিল কাকাবাবু। আজ সব শেষ করলুম।’

নিশানাথ আমাদের বলিলেন,–’বনলক্ষ্মী হচ্ছে আমাদের দাৰ্জিখানার পরিচালিকা‌, কলোনীর সব কাপড়-জামা ওই সেলাই করে। —আচ্ছা‌, আমরা যাচ্ছি। বনলক্ষ্মী। তোমাকে শুধু বলতে এসেছিলাম‌, মুকুলের মাথা ধরেছে সে রাঁধতে পারবে না‌, দময়ন্তী এক রান্না নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। তুমি সাহায্য করলে ভাল হত।’

‘ওমা‌, এতক্ষণ জানতে পারিনি!’ বনলক্ষ্মী কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দ্রুত আমাদের সামনে দিয়া বাহির হইয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল।

বনলক্ষ্মী চলিয়া গেল। কিন্তু আমার মনে একটি রেশ রাখিয়া গেল। পল্লীগ্রামের শীতল তরুচ্ছায়া‌, পুকুরঘাটের টলমল জল-তাহাকে দেখিলে এই সব মনে পড়িয়া যায়। সে রূপসী নয়‌, কিন্তু তাহাকে দেখিতে ভাল লাগে; মুখখানিতে একটি কচি স্নিগ্ধতা আছে। বয়স উনিশ-কুড়ি‌, নিটোল স্বাস্থ্য-মসৃণ দেহ‌, কিন্তু দেহে যৌবনের উগ্রতা নাই। নিতান্ত ঘরোয়া আটপৌরে গৃহস্থঘরের মেয়ে।

বনলক্ষ্মী দৃষ্টি-বহির্ভূত হইয়া গেলে ব্যোমকেশ বলিল,–’রমেনবাবু্‌, কি বলেন?’

রমেনবাবু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’মিছে আপনাদের কষ্ট দিলাম। আমারই ভুল‌, সুনয়না। এখানে নেই।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’এখানে আর কোনও মহিলা নেই?’

‘না। চলুন এবার ফেরা যাক। খাবার তৈরি হতে এখনও বোধহয় দেরি আছে। তৈরি হলেই দময়ন্তী খবর পাঠাবে।’

সিধা পথে নিশানাথবাবুর বাড়িতে ফিরিয়া পাখার তলায় বসিলাম। রমেনবাবু হঠাৎ বলিলেন,–’আচ্ছা‌, নেত্যকালী-মানে সুনয়না যে এখানে আছে। এ সন্দেহ আপনার হল কি করে? কেউ কি আপনাকে খবর দিয়েছিল?’

নিশানাথ শুষ্কম্বরে বলিলেন,–’এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। It is not my secret. অন্য কিছু জানতে চান তো বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’একটা অবাস্তর প্রশ্ন করছি কিছু মনে করবেন না। কেউ কি আপনাকে blackmail করছে?’

নিশানাথ দৃঢ়স্বরে বলিলেন,–’না।’

তারপর সাধারণ গল্পগুজবে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল। পেটের মধ্যে একটু ক্ষুধার কামড় অনুভব করিতেছি এমন সময় ভিতর দিকের দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল বনলক্ষ্মী। স্নানের পর বেশ পরিবর্তন করিয়াছে‌, পিঠে ভিজা চুল ছড়ানো। বলিল, —’কাকাবাবু্‌, খাবার দেওয়া হয়েছে।’

0 Shares