নিশানাথ উঠিয়া বলিলেন,–’কোথায়?’
বনলক্ষ্মী বলিল, —‘এই পাশের ঘরে। আপনারা আবার কষ্ট করে অতদূরে যাবেন, তাই আমরা খাবার নিয়ে এসেছি।’
নিশানাথ আমাদের বলিলেন,–’চলুন। ওরাই যখন কষ্ট করেছে তখন আমাদের আর কষ্ট করতে হল না। —কিন্তু আর সকলের কি ব্যবস্থা হবে?
বনলক্ষ্মী বলিল,–’গোঁসাইদ রান্নাঘরের ভার নিয়েছেন। —আসুন।’
পাশের ঘরে টেবিলের উপর আহারের আয়োজন। তবে ছুরি-কাঁটা নাই, শুধু চামচ। আমরা বসিয়া গেলাম। রান্নার পদ অনেকগুলি : ঘি-ভাত, সোনামুগের ডাল, ইচড়ের ডালনা, চিংড়িমাছের কাটলেট, কচি আমের ঝোল, পায়স ও ছানার বরফি। উদর পূৰ্ণ করিয়া আহার করিলাম। দময়ন্তী দেবী ও বনলক্ষ্মীর নিপুণ পরিচযায় ভোজনপর্ব পরম পরিতৃপ্তির সহিত সম্পন্ন হইল; লক্ষ্য করিলাম, দময়ন্তী দেবী অতি সুদক্ষা গৃহিণী, তাঁহার চোখের ইঙ্গিতে বনলক্ষ্মী যন্ত্রের মত কাজ করিয়া গেল।
আহারাস্তে আবার বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিলাম। পান ও সিগারেট লইয়া বনলক্ষ্মী আসিল, টেবিলের উপর রাখিয়া আমাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন কৌতুহলের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গেল।
‘তোমরা এবার খেয়ে নাও’ বলিয়া নিশানাথও ভিতরে গেলেন।
বনলক্ষ্মীকে এতক্ষণ দেখিয়া তাহার চরিত্র সম্বন্ধে যেন একটা ধারণা করিতে পারিয়াছি। সে স্বভাবতাই মুক্ত-প্ৰাণ extrovert প্রকৃতির মেয়ে, কিন্তু কোনও কারণে নিজেকে চাপিয়া রাখিয়াছে, কাহারও কাছে আপন প্রকৃত স্বভাব প্রকাশ করিতেছে না।
কিছুকাল ধরিয়া ধূমপান চলিল। নিশানাথ ভিতরে বাহিরে যাতায়াত করিতে লাগিলেন। শেষে বলিলেন,–’আপনাদের ফিরে যাবার তাড়া নেই তো?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’তাড়া থাকলেও অসমর্থ। মিসেস সেন যে-রকম খাইয়েছেন, নড়বার ক্ষমতা নেই। আপনি কি বলেন, রমেনবাবু?’
রমেনবাবু একটি উদগার তুলিয়া বলিলেন,–’খাওয়ার পর নড়াচড়া আমার গুরুর বারণ।’
নিশানাথ হাসিলেন,–’তবে আসুন, ওঘরে বিছানা পাতিয়ে রেখেছি, একটু গড়িয়ে নিন।’
একটি বড় ঘর। তাহার মেঝেয় তিনজনের উপযোগী বিছানা পাতা হইয়াছে। ঘরের দেয়াল ঘেষিয়া একটি একানে খাট; খাটের পাশে টুলের উপর টেবিল-ফ্যান। অনুমান করিলাম নিশানাথবাবুর এটি শয়নকক্ষ। ঘরের জানালাগুলি বন্ধ, তাই ঘরটি স্নিগ্ধ ছায়াচ্ছন্ন। আমরা বিছানায় বসিলাম। নিশানাথবাবু টেবিল-ফ্যানটি মেঝোয় নামাইয়া চালাইয়া দিলেন। বলিলেন,–’এ ঘরের সীলিং-ফ্যানটা সারাতে দিয়েছি। তাই টেবিল-ফ্যান চালাতে হচ্ছে। কষ্ট হবে না তো?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’কিছু কষ্ট হবে না। আপনি এবার একটু বিশ্রাম করুন গিয়ে।’
নিশানাথ বলিলেন,–’দিনের বেলা শোয়া আমার অভ্যাস নেই–’
‘তাহলে বসুন, খানিক গল্প করা যাক।’
নিশানাথ বসিলেন। রমেনবাবু কিন্তু পাঞ্জাবি খুলিয়া লম্বা হইলেন। গুরুভক্ত লোক, গুরুর আদেশ অমান্য করেন না। আমরা তিনজনে বসিয়া নিম্নস্বরে আলাপ করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ বলিল,–’বনলক্ষ্মী কি চলে গেছে?’ নিশানাথ বলিলেন,–’হ্যাঁ, এই চলে গেল। কেন বলুন দেখি?’
‘ওর ইতিহাস শুনতে চাই। ও যখন গোলাপ কলোনীতে আশ্রয় পেয়েছে তখন ওর নিশ্চয় কোন দাগ আছে।‘
‘তা আছে। ইতিহাস খুবই সাধারণ। ও পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, এক লম্পট ওকে ভুলিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসে, তারপর কিছুদিন পরে ফেলে পালায়। গাঁয়ে ফিরে যাবার মুখ নেই, কলকাতায় খেতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কলোনীতে আশ্রয় পেয়েছে।’
‘কতদিন আছে?’
‘বছর দেড়েক।’
‘ওর গল্প সত্যি কিনা যাচাই করেছিলেন?’
‘। ও নিজের গ্রামের নাম কিছুতেই বলল না।’
‘হুঁ। গোলাপ কলোনীর সন্ধান ও পেল কি করে? এটা তো সরকারী অনাথ আশ্রম নয়।’
নিশানাথ একটু মুখ গম্ভীর করিলেন, বলিলেন,–’ও নিজে আসেনি, বিজয় একদিন ওকে নিয়ে এল। কলকাতায় হগ মার্কেটের কাছে একটা রেস্তোরা আছে, বিজয় রোজ বিকেলে সেখানে চা খায়। একদিন দেখল একটি মেয়ে কোণের টেবিলে একলা বসে বসে কাঁদছে। বনলক্ষ্মীর তখন হাতে একটি পয়সা নেই, দুদিন খেতে পায়নি, স্রেফ চা খেয়ে আছে। ওর কাহিনী শুনে বিজয় ওকে নিয়ে এল।’
‘ওর চাল-চলন আপনার কেমন মনে হয়?’
‘ওর কোনও দোষ আমি কখনও দেখিনি। যদি ওর পদস্থলন হয়ে থাকে। সে ওর চরিত্রের দোষ নয়, অদৃষ্ট্রের দোষ।।’ এই বলিয়া নিশানাথ হঠাৎ উঠিয়া পড়িলেন। ‘এবার বিশ্রাম করুন বলিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিয়া প্ৰস্থান করিলেন।
তাঁহার এই হঠাৎ উঠিয়া যাওয়া কেমন যেন বেখাপ্পা লাগিল। পাছে ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তরে আরও কিছু বলিতে হয় তাই কি তাড়াতাড়ি উঠিয়া গেলেন?
আমরা শয়ন করিলাম। মাথার কাছে গুঞ্জনধ্বনি করিয়া পাখা ঘুরিতেছে। পাশে রমেনবাবু ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন; তাঁহার নাক ডাকিতেছে না, চুপি চুপি জল্পনা করিতেছে। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, একটি চটক-দম্পতি কোন অদৃশ্য ছিদ্রপথে ঘরে প্রবেশ করিয়া ছাদের একটি লোহার আংটায় বাসা বাঁধিতেছে। চোরের মত কুটা মুখে করিয়া আসিতেছে, কুটা রাখিয়া আবার চলিয়া যাইতেছে। তাঁহাদের পাখার মৃদু শব্দ হইতেছে-ফর্র্ ফর্র্–
চিৎ হইয়া শুইয়া তাঁহাদের নিভৃত গৃহ-নির্মাণ দেখিতে দেখিতে চক্ষু মুদিয়া আসিল।
৭
বৈকালে আবার বাহিরের ঘরে সমবেত হইলাম। দময়ন্তী দেবী চায়ের বদলে শীতল ঘোলের সরবৎ পরিবেশন করিয়া গেলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’রোদ একটু পডুক, তারপর বেরুবেন। সাড়ে পাঁচটার সময় মুস্কিল গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যায়, সেই গাড়িতে গেলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন পাবেন।’