‘বেশ বেশ। তা তোমার আগের বৌটি মারা গেছে বুঝি?’
‘মারা আর গেল কৈ? বাঁজা মনিষ্যি ছিল, মানুষটা মন্দ ছিল না। কিন্তু নতুন বেঁটারে যখন ঘরে আনলাম, কর্তাবাবু কইলেন, দুটা বৌ লৈয়া কলোনীতে থাকা চলাব না। কি করা! দিলাম পুরান বৌটারে তালাক দিয়া।’
এই সময় হুড়মুড় শব্দে ট্রেন আসিয়া পড়িল। মুস্কিল মিঞার সহিত রসালাপ অসমাপ্ত রাখিয়া আমরা ট্রেন ধরিলাম।
ট্রেনে উঠিয়া ব্যোমকেশ আর কথা বলিল না, অন্যমনস্কভাবে বাহিরের দিকে তাকাইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু রমেনবাবু্, গাড়ি যতাই কলিকাতার নিকটবর্তী হইতে লাগিল, ততাই উৎফুল্প হইয়া উঠিলেন। আমরা দু’জনে নানা গল্প করিতে করিতে চলিলাম। একবার সুনয়নার কথা উঠিল। তিনি বলিলেন,–’আদালতে হলফ নিয়ে যদি বলতে হয়, তবে বলব সুনয়না ওখানে নেই। কিন্তু তবুও মনের খুৎখুতুনি যাচ্ছে না।’
আমি বলিলাম,–’কিন্তু সুনয়না ছদ্মবেশে ওখানে আছে এটাই বা কি করে হয়? রাতদিন মেক-আপ করে থাকা কি সম্ভব?
রমেনবাবু বলিলেন,–’সুনয়না ছদ্মবেশে কলোনীতে আছে একথা আমিও বলছি না। ওখানে স্বাভাবিক বেশেই আছে। কিন্তু সে ছদ্মবেশ ধারণ করে সিনেমা করতে গিয়েছিল, আমি তাকে ছদ্মবেশে দেখেছি, এটা তো সম্ভব?
এই সময় ব্যোমকেশ বলিল,–’ঝড় আসছে!’
উৎসুকভাবে বাহিরের দিকে তাকাইলাম। কিন্তু কোথায় ঝড়! আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নাই। সবিস্ময়ে ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া দেখি সে চোখ বুজিয়া বসিয়া আছে। বলিলাম,–’ঝড়ের স্বপ্ন দেখছি নাকি?’
সে চোখ খুলিয়া বলিল,–’এ ঝড় সে ঝড় নয়—গোলাপ কলোনীতে ঝড় আসছে। অনেক উত্তাপ জমা হয়েছে, এবার একটা কিছু ঘটবে।’
‘কি ঘটবে?’
‘তা যদি জানতাম তাহলে তার প্রতিকার করতে পারতাম।’ বলিয়া সে আবার চোখ বুজিল।
শিয়ালদা স্টেশনে যখন পৌঁছিলাম তখন রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। রমেনবাবুর সহিত ছাড়াছাড়ি হইবার পূর্বে ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনাকে আর একটু কষ্ট দেব। সুনয়নার দুটো স্টিল-ফটো যোগাড় করতে হবে। একটা কমলমণির ভূমিকায়, একটা শ্যামা-ঝি’র।’
রমেনবাবু বলিলেন,–’কালই পাবেন।’
৯
পরদিন সকালে সংবাদপত্র পাঠ শেষ হইলে ব্যোমকেশ নিজের ভাগের কাগজ সযত্নে পাট করিতে করিতে বলিল, —’কাল চারটি স্ত্রীলোককে আমরা দেখেছি। তার মধ্যে কোনটিকে সবচেয়ে সুন্দরী বলে মনে হয়?’
স্ত্রীলোকের রূপ লইয়া আলোচনা করা ব্যোমকেশের স্বভাব নয়; কিন্তু হয়তো তাহার কোনও উল্ম আছে তাই বললাম-দময়ী দেবীকেই সবচেয়ে সুন্দরী বলতে হয়—‘
‘কিন্তু—‘
চকিত হইয়া বলিলাম,–’কিন্তু কি?’
‘তোমার মনে কিন্তু আছে। ‘ ব্যোমকেশ সহসা আমার দিকে তর্জনী তুলিয়া বলিল,–’কাল রাত্রে কাকে স্বপ্ন দেখেছ?’
এবার সত্যিই ঘাবড়াইয়া গেলাম্,–’স্বপ্ন! কৈ না–’
‘মিছে কথা বোলো না। কাকে স্বপ্ন দেখেছি?’
তখন বলিতে হইল। স্বপ্ন দেখার উপর যদিও কাহারও হাত নাই, তবু লজ্জিতভাবেই বলিলাম,–’বনলক্ষ্মীকে।’
‘কি স্বপ্ন দেখলে?’
‘দেখলাম, সে যেন হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে, আর হাসছে।–কিন্তু একটা আশ্চর্য দেখলাম, তার দাঁতগুলো যেন ঠিক তার দাঁতের মত নয়। যতদূর মনে পড়ে তার সত্যিকারের দাঁত বেশ পাটি-মেলানো। কিন্তু স্বপ্নে দেখলাম, কেমন যেন এব্ড়ো খেব্ড়ো—’
ব্যোমকেশ অবাক হইয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল–’তোমার স্বপ্নেও দাঁত আছে!’
‘তার মানে? তুমিও স্বপ্ন দেখেছি নাকি? কাকে?’
সে হাসিয়া বলিল,–’সত্যবতীকে। কিন্তু তার দাঁত নিজের মত নয়, অন্যরকম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দাঁত অমন কেন? সত্যবতী জোরে হেসে উঠল, আর তার দাঁতগুলো ঝরঝর করে পড়ে গেল।’
আমিও জোরে হাসিয়া উঠিলাম, বলিলাম,–’এসব মনঃসমীক্ষণের ব্যাপার। চল, গিরীন্দ্ৰশেখর বসুকে ধরা যাক, তিনি হয়তো স্বপ্ন-মঙ্গলের ব্যাখ্যা করতে পারবেন।’
এই সময় দ্বারের কড়া নড়িল।
ব্যোমকেশ দ্বার খুলিয়া দিলে ঘরে প্রবেশ করিল বিজয়। ঠোঁট চাটিয়া বলিল,–’আমি নিশানাথবাবুর ভাইপো—’
ব্যোমকেশ বলিল,–’পরিচয় দিতে হবে না, বিজয়বাবু্, কাল আপনাকে দেখেছি। তা কি খবর?’
বিজয় বলিল,–’ককা চিঠি দিয়েছেন। আমাকে বললেন চিঠিখানা পৌঁছে দিতে।’
সে পকেট হইতে একটা খাম বাহির করিয়া ব্যোমকেশকে দিল। বিজয়ের ভাবগতিক দেখিয়া মনে হয় তাহার মন খুব সুস্থ নয়। সে রুমাল দিয়া গলার ঘাম মুছিল, একটা কিছু বলিবার জন্য মুখ খুলিল, তারপর কিছু না বলিয়াই প্রস্থনোদ্যত হইল।
ব্যোমকেশ চিঠি পকেটে রাখিয়া বলিল,–’বসুন।’
বিজয় ক্ষণকাল ন যযৌ হইয়া রহিল, তারপর চেয়ারে বসিল। অপ্ৰতিভ হাসিয়া বলিল,–’কাল আমিও আপনাকে দেখেছিলাম, কিন্তু তখন পরিচয় জানতাম না—‘
‘পরিচয় কার কাছে জানলেন?’
‘কাল সন্ধের পর কলোনীতে ফিরে গিয়ে জানতে পারলাম। কাকা আপনাকে কোনও দরকারে ডেকেছিলেন বুঝি?’
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল,–’একথা আপনার কাকাকে জিগ্যেস করলেন না কেন?’
বিজয়ের মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সে বলিল,–’ককা সব কথা আমাদের বলেন না। তবে ঐ মোটরের টুকরো নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছেন তাই বোধহয়—‘
‘মোটরের টুকরো সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?’
‘আমার তো মনে হয় একেবারে ছেলেমানুষী। মাইলখানেক দূরে গ্রাম আছে, গ্রামের ছোঁড়ারা প্রায়ই ঐ মোটরগুলোর মধ্যে এসে খেলা করে। আমার বিশ্বাস তারাই বজ্জাতি করে মোটরের টুকরো কলোনীতে ফেলে যায়।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’ই, আচ্ছা ওকথা যাক। প্রফেসর নেপাল গুপ্তর খবর কি?’