চিড়িয়াখানা

ব্ৰজদাস : বয়স ৬০। নিশানাথের সেরেস্তার কেরানি ছিল‌, চুরির জন্য নিশানাথ তাহার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়া তাহাকে জেলে পাঠাইয়াছিলেন। জেল হইতে বাহির হইয়া ব্ৰজদাস কলোনীতে আশ্ৰয় লইয়াছে। সে নাকি এখন সদা সত্য কথা বলে। লোকটিকে দেখিয়া চতুর ব্যক্তি বলিয়া মনে হয়।

ভুজঙ্গধর দাস . বয়স ৩৯-৪০। অত্যন্ত বুদ্ধিমান‌, অবস্থার শোচনীয় অবনতি সত্ত্বেও মনের ফুর্তি নষ্ট হয় নাই। ধৰ্মজ্ঞান প্রবল নয়‌, লজ্জাকর দুনৈতিক কর্মে ধরা পড়িয়াও লজ্জা নাই। বনলক্ষ্মীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ। (কেন?) ভাল সেতার বাজাইতে পারেন। চার বছর কলোনীতে আছেন।

বনলক্ষ্মী : বয়স ২২-২৩। স্নিগ্ধ যৌবনশ্রী; যৌন আবেদন আছে-(অজিত তাহাকে স্বপ্ন দেখিয়াছে) কিন্তু তাহাকে দেখিয়া মনে হয় না সে কুলত্যাগিনী। চঞ্চলা নয়‌, প্ৰগলভা নয়। কর্মকুশলা; একটু গ্ৰাম্য ভাব আছে। দেড় বছর আগে বিজয় তাহাকে কলোনীতে আনিয়াছে।

মুস্কিল মিঞা : বয়স ৫০। নেশাখোর (বোধহয় আফিম) কিন্তু হুঁশিয়ার লোক। কলোনীর সব খবর রাখে। তাহার বিশ্বাস কলিকাতার দোকানে চুরি হইতেছে। দেড় বছর আগে নূতন বিবি বিবাহ করিয়া ঘরে আনিয়াছে‌, পুরাতন বিবিকে তালাক দিয়াছে।

নজর বিবি : বয়স ২০-২১। পশ্চিমের মেয়ে‌, আগে বাংলা জানিত না‌, বিবাহের পর শিখিয়াছে। ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া মনে হয়। কলোনীর অধিবাসীদের লজ্জা করে না‌, কিন্তু বাহিরের লোক দেখিলে ঘোমটা টানে।

রসিক দে; বয়স ৩৫। নিজের বর্তমান অবস্থায় তুষ্ট নয়। দোকানের হিসাব লইয়া নিশানাথের সহিত গণ্ডগোল চলিতেছে। চেহারা রুগ্ন‌, চরিত্র বৈশিষ্ট্যহীন। (কালো ঘোড়া?)

খাতা বন্ধ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’কেমন?’

ব্যোমকেশ আমাকে বনলক্ষ্মী সম্পর্কে খোঁচা দিয়াছে‌, আমিও তাহাকে খোঁচা দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না‌,–’ঠিক আছে। কেবল একটা কথা বাদ গেছে। নেপালবাবু ভাল দাবা খেলেন উল্লেখ করা উচিত ছিল।’

ব্যোমকেশ আমাকে একবার ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর হাসিয়া বলিল,–’আচ্ছা‌, শোধ-বোধ।’

সন্ধ্যার সময় রমেনবাবুর চাকর আসিয়া একটি খাম দিয়া গেল। খামের মধ্যে দুইটি ফটো।

ফটো দুইটি আমরা পরম আগ্রহের সহিত দর্শন করিলাম। কমলমণি সত্যই বঙ্কিমচন্দ্রের কমলমণি‌, লাবণ্যে মাধুর্যে ঝলমল করিতেছে। আর শ্যামা ঝি সত্যই জবরদস্তু শ্যামা ঝি। দুইটি আকৃতির মধ্যে কোথাও সাদৃশ্য নাই। এবং গোলাপ কলোনীর কোনও মহিলার সঙ্গে ছবি দুইটির তিলমাত্র মিল নাই।

১০

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিল টেলিফোনের শব্দে।

টেলিফোনের সহিত যাঁহারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত তাঁহারা জানেন‌, টেলিফোনের কিড়িং কিড়িং শব্দ কখনও কখনও ভয়ঙ্কর ভবিতব্যতার আভাস বহন করিয়া আনে। যেন তারের অপর প্রাস্তে যে-ব্যক্তি টেলিফোন ধরিয়াছে‌, তাহার অব্যক্ত হৃদয়াবেগ বিদ্যুতের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়।

বিছানায় উঠিয়া বসিয়া উৎকৰ্ণ হইয়া শুনিলাম‌, কিন্তু কিছু বুঝিতে পারিলাম না। দুই-তিন মিনিট পরে ব্যোমকেশ টেলিফোন রাখিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার মুখে-চোখে একটা অনভ্যস্ত ধাঁধা-লাগার আভাস; সে বলিল,–’ঝড় এসে গেছে।’

‘ঝড়!’

‘নিশানাথবাবু মারা গেছেন। চল‌, এখনি বেরুতে হবে।’

আমার মাথায় যেন অতর্কিতে লাঠির ঘা পড়িল! কিছুক্ষণ। হতভম্ব থাকিয়া শেষে ক্ষীণকণ্ঠে বলিলাম,–’নিশানাথবাবু মারা গেছেন! কি হয়েছিল?’

‘সেটা এখনও বোঝা যায়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে‌, আবার নাও হতে পারে।’

‘কিন্তু এ যে বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ মারা গেলেন?’

‘কাল রাত্রে। ঘুমন্ত অবস্থায় হয়তো রক্তের চাপ বেড়েছিল‌, হার্টফেল করে মারা গেছেন।

‘কে ফোন করেছিল?’

‘বিজয়। ওর সন্দেহ হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। ভয় পেয়েছে মনে হল।–নাও‌, চটপট উঠে পড়। ট্রেনে গেলে দেরি হবে‌, ট্যাক্সিতে যাব।’

ট্যাক্সিতে যখন গোলাপ কলোনীর ফটকের সম্মুখে পৌঁছিলাম‌, তখনও আটটা বাজে নাই‌, কিন্তু প্রখর সূর্যের তাপ কড়া হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ট্যাক্সির ভাড়া চুকাইয়া দিয়া আমরা ভিতরে প্ৰবেশ করিলাম।

বাগান নিঝুম; মালীরা কাজ করিতেছে না। কুঠিগুলিও যেন শূন্য। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম কোথাও জনমানব নাই।

আমরা নিশানাথবাবুর বাড়ির সম্মুখীন হইলে বিজয় বাহির হইয়া আসিল। তাহার চুল এলোমেলো‌, গায়ে একটা চাদর‌, পা খালি‌, চোখ জবাফুলের মত লাল। ভাঙা গলায় বলিল,–’আসুন।’

বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’চলুন‌, আগে একবার দেখি‌, তারপর সব কথা শুনব।’

বিজয় আমাদের পাশের ঘরে লইয়া গেল; যে-ঘরে সেদিন দুপুরবেলা আমরা শয়ন করিয়াছিলাম সেই ঘর। জানালা খোলা রহিয়াছে। ঘরের একপাশে খাট‌, খাটের উপর সাদা চাদর-ঢাকা মৃতদেহ।

আমরা খাটের পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ সন্তৰ্পণে চাদর তুলিয়া লইল।

নিশানাথবাবু যেন ঘুমাইয়া আছেন। তাঁহার পরিধানে কেবল সিস্কের ঢ়িলা পায়জামা‌, গায়ে জামা নাই। তাঁহার মুখের ভাব একটু ফুলো ফুলো‌, যেন মুখে অধিক রক্ত সঞ্চার হইয়াছে। এ ছাড়া মৃত্যুর কোনও চিহ্ন শরীরে বিদ্যমান নাই।

নীরবে কিছুক্ষণ মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ হঠাৎ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল,–’এ কি? পায়ে মোজা!’

এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই-নিশানাথের পায়ের চেটো পায়জামার কাপড়ে প্রায় ঢাকা ছিল-এখন দেখিলাম সত্যই তাঁহার পায়ে মোজা। ব্যোমকেশ কুকিয়া দেখিয়া বলিল,—’গরম মোজা! উনি কি মোজা পায়ে দিয়ে শুতেন?’

0 Shares