বিজয় আচ্ছন্নের মত দাঁড়াইয়া ছিল, মাথা নাড়িয়া বলিল,–’না।’
অতঃপর ব্যোমকেশ মৃতদেহের উপর আবার চাদর ঢাকা দিয়া বলিল,–’চলুন, দেখা হয়েছে। ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছেন কি? ডাক্তারের সার্টিফিকেট তো দরকার হবে।’
বিজয় বলিল,–’মুস্কিল গাড়ি নিয়ে শহরে গেছে, ডাক্তার নগেন পাল এখানকার বড় ডাক্তার—। কি বুঝলেন, ব্যোমকেশবাবু?
‘ও কথা পরে হবে।–আপনার কাকিমা কোথায়?’
‘কাকিমা অজ্ঞান হয়ে আছেন।’ বিজয় আমাদের পাশের ঘরের দ্বারের কাছে লইয়া গেল। পদাৰ্থ সরাইয়া দেখিলাম, ও ঘরটিও শয়নকক্ষ। খাটের উপর দময়ন্তী দেবী বিস্রস্তভাবে পড়িয়া আছেন, ডাক্তার ভুজঙ্গধর পাশে বসিয়া তাঁহার শুশ্রুষা করিতেছেন; মাথায় মুখে জল দিতেছেন, নাকের কাছে অ্যামোনিয়ার শিশি ধরিতেছেন।
আমাদের দেখিতে পাইয়া ভুজঙ্গধরবাবু লঘুপদে আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মুখ বিষগ্ৰগম্ভীর; স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া চটুলতা সাময়িকভাবে অস্তমিত হইয়াছে। তিনি খাটো গলায় বলিলেন,–’এখনও জ্ঞান হয়নি, তবে বোধহয় শীগগিরই হবে।’
ফিস ফিস করিয়া কথা হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে আছেন?’
ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,–’প্রায় তিন ঘন্টা। উনিই প্ৰথমে জানতে পারেন। ঘুম ভাঙার পর বোধহয় স্বামীর ঘরে গিয়েছিলেন, দেখে চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এখনও জ্ঞান হয়নি।‘
‘আপনি মৃতদেহ দেখেছেন?’
‘দেখেছি।‘
‘আপনার কি মনে হয়? স্বাভাবিক মৃত্যু?’
ডাক্তার একবার চোখ বড় করিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন,–’এ বিষয়ে আমার কিছু বলবার অধিকার নেই। পাকা ডাক্তার আসুন, তিনি যা হয় বলবেন।’ বলিয়া ভুজঙ্গধরবাবু আবার দময়ন্তী দেবীর খাটের পাশে গিয়া বসিলেন।
আমরা বাহিরের ঘরে ফিরিয়া গেলাম। ইতিমধ্যে বৈষ্ণব ব্ৰজদাস বাহিরের ঘরে আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছিলেন, আমাদের দেখিয়া নত হইয়া নমস্কার করিলেন। তাঁহার মুখে শোকাহত ব্যাকুলতার সহিত তীক্ষ্ণ উৎকণ্ঠার চিহ্ন মুদ্রিত রহিয়াছে। তিনি ভগ্নস্বরে বলিলেন,–’এ কি হল আমাদের! এতদিন পর্বতের আড়ালে ছিলাম, এখন কোথায় যাব?’
আমরা উপবেশন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,–’কোথাও যাবার দরকার হবে না বোধহয়। কলোনী যেমন চলছে তেমনি চলবে।–বসুন।’
ব্ৰজদাস বসিলেন না, দ্বিধাগ্রস্ত মুখে জানালায় পিঠি দিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল,–’কাল নিশানাথবাবুকে আপনি শেষ কখন দেখেছিলেন?’
‘বিকেলবেলা। তখন তো বেশ ভালই ছিলেন।’
‘ব্লাড-প্রেসারের কথা কিছু বলেছিলেন?’
‘কিচ্ছু না।’
বাহিরে মুস্কিলের গাড়ি আসিয়া থামিল। বিজয় বাহিরে গিয়া ডাক্তার নগেন্দ্ৰ পালকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। ডাক্তার পালের হাতে ব্যাগ, পকেটে স্টেথ’স্কেপ, লোকটি প্ৰবীণ কিন্তু বেশ চটুপটে। মৃদু কণ্ঠে আক্ষেপের বাঁধা বুলি আবৃত্তি করিতে করিতে বিজয়ের সঙ্গে পাশের ঘরে প্ৰবেশ করিলেন। তাঁহার কথার ভগ্নাংশ কানে আসিল,–’সব রোগের ওষুধ আছে, মৃত্যু রোগের ওষুধ নেই…’
তিনি পাশের ঘরে অন্তৰ্হিত হইলে ব্যোমকেশ ব্ৰজদাসকে জিজ্ঞাসা করিল,–’ডাক্তার পাল প্রায়ই আসেন বুঝি?’
ব্ৰজদাস বলিলেন,–’মাসে দু’ মাসে একবার আসেন। কলোনীর বাঁধা ডাক্তার। অবশ্য ভুজঙ্গধরবাবুই এখানকার কাজ চালান। নেহাৎ দরকার হলে এঁকে ডাকা হয়।’
পনেরো মিনিট পরে ডাক্তার পাল বাহিরে আসিলেন। মুখে একটু লৌকিক বিষন্নতা। তাঁহার পিছনে বিজয় ও ভুজঙ্গধরবাবুও আসিলেন। ডাক্তার পাল ব্যোমকেশের প্রতি একটি চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, মনে হইল তিনি বিজয়ের কাছে ব্যোমকেশের পরিচয় শুনিয়াছেন। তারপর চেয়ারে বসিয়া ব্যাগ হইতে শিরোনামা ছাপা কাগজের প্যাড় বাহির করিয়া লিখিবার উপক্রম করিলেন।
ব্যোমকেশ তাঁহার দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, —’মাফ করবেন, আপনি কি ডেথ সার্টিফিকেট লিখছেন?’
ডাক্তার পাল ভ্রূ তুলিয়া চাহিলেন, বলিলেন,–’হ্যাঁ।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনি তাহলে মনে করেন স্বাভাবিক মৃত্যু?
ডাক্তার পাল ঠোঁটের কোণ তুলিয়া একটু হাসিলেন, বলিলেন,–’স্বাভাবিক মৃত্যু বলে কিছু নেই, সব মৃত্যুই অস্বাভাবিক। শরীরের অবস্থা যখন অস্বাভাবিক হয়, তখনই মৃত্যু হতে পারে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’তা ঠিক। কিন্তু শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থা আপনা থেকে ঘটতে পারে, আবার বাইরে থেকে ঘটানো যেতে পারে।’
ডাক্তার পালের ভূ আর একটু উপরে উঠিল। তিনি বলিলেন, —’আপনি ব্যোমকেশবাবু্, না? আপনি কী বলতে চান আমি বুঝেছি। কিন্তু আমি নিশানাথবাবুর দেহ ভাল করে পরীক্ষা করেছি, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। মৃত্যুর সময় কাল রাত্রি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। আমার বিচারে কাল রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় ওঁর মাথার শিরা ছিঁড়ে যায়, তারপর ঘুমন্ত অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছে। যারা ব্লাড-প্রেসারের রুগী তাদের মৃত্যু সাধারণত এইভাবেই হয়ে থাকে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’কিন্তু ওঁর পায়ে মোজা ছিল লক্ষ্য করেছেন বোধহয়। এই দারুণ গ্ৰীষ্মে তিনি মোজা পরে শুয়েছিলেন একথা কি বিশ্বাসযোগ্য?’
ডাক্তার পালের মুখে একটু দ্বিধার ভাব দেখা গেল। তিনি বলিলেন,–’ওটা যদিও ডাক্তারি নিদানের এলাকায় পড়ে না, তবু ভাববার কথা। নিশানাথবাবু এই গরমে মোজা পায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আর কেউ তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় মোজা পরিয়ে দিয়েছে তাই বা কি করে বিশ্বাস করা যায়? কেউ সে-চেষ্টা করলে তিনি জেগে উঠতেন না? আপনার কি মনে হয়?’