চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’ভাবনা-চিন্তা কিছু নেই বলছেন। কিন্তু সম্প্রতি আপনার ভাবনার বিশেষ কারণ ঘটেছে। নইলে আমার কাছে আসতেন না।’

নিশানাথ হাসিলেন; অধর প্রান্তে শুভ্র দন্তরেখা অল্প দেখা গেল। বলিলেন‌, —’হ্যাঁ—! এটা অবশ্য অনুমান করা শক্ত নয়। কিছুদিন থেকে আমার কলোনীতে একটা ব্যাপার ঘটছে–’ তিনি থামিয়া গিয়া আমার দিকে চোখ ফিরাইলেন,–’আপনি অজিতবাবু?’

ব্যোমকেশ বলিল,–‘হ্যাঁ‌, উনি আমার সহকারী। আমার কাছে যা বলবেন ওঁর কাছে তা গোপন থাকবে না।’

নিশানাথ বলিলেন,–’না না‌, আমার কথা গোপনীয় নয়। উনি সাহিত্যিক‌, তাই ওঁর কাছে একটা কথা জানবার ছিল। অজিতবাবু্‌, blackmail শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কি?’

আকস্মিক প্রশ্নে অপ্ৰতিভ হইয়া পড়িলাম। বাংলা ভাষা লইয়া অনেকদিন নাড়াচাড়া করিতেছি‌, জানিতে বাকী নাই যে বঙ্গভারতী আধুনিক পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার সহিত তাল রাখিয়া চলিতে পারেন নাই; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাবকে বিদেশী শব্দ দ্বারা প্ৰকাশ করিতে হয়। আমি আমতা-আমতা করিয়া বলিলাম,–’Blackmail-গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। যতদূর জানি এককথায় এর বাংলা প্রতিশব্দ নেই।’

নিশানাথবাবু একটু অবজ্ঞার স্বরে বলিলেন,–’আমিও তাই ভেবেছিলাম। যা হোক‌, ওটা অবাস্তর কথা। এবার ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি শুনুন।’‌

ব্যোমকেশ বলিল,–’সংক্ষেপে বলবার দরকার নেই‌, বিস্তারিত করেই বলুন। তাতে আমাদের বোঝবার সুবিধে হবে।’

নিশানাথ বলিলেন,–’আমার গোলাপ কলোনীতে যারা আমার অধীনে কাজ করে‌, মালীদের বাদ দিলে তারা সকলেই ভদ্রশ্রেণীর মানুষ‌, কিন্তু সকলেই বিচিত্র ধরনের লোক। কাউকেই ঠিক সহজ। সাধারণ মানুষ বলা যায় না। স্বাভাবিক পথে জীবিকা অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়‌, তাই তারা আমার কাছে এসে জুটেছে। আমি তাদের থাকবার জায়গা দিয়েছি‌, খেতে পরতে দিই‌, মাসে মাসে কিছু হাতখরচ দিই। এই শর্তে তারা কলোনীর কাজ করে। অনেকটা মঠের মত ব্যবস্থা। খুব আরামের জীবন না হতে পারে‌, কিন্তু না খেয়ে মরবার ভয় নেই।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আর একটু পরিষ্কার করে বলুন। এদের পক্ষে স্বাভাবিক পথে জীবন নিবহি সম্ভব নয় কেন?’

নিশানাথ বলিলেন,–’এদের মধ্যে একদল আছে যারা শরীরের কোনও না কোনও খুঁতের জন্যে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাত্রা নিবাহ করতে পারে না। যেমন‌, পানুগোপাল। বেশ স্বাস্থ্যবান ছেলে‌, অথচ সে কানে ভাল শুনতে পায় না‌, কথা বলাও তার পক্ষে কষ্টকর। অ্যাডোনয়েডের দোষ আছে। লেখাপড়া শেখেনি। তাকে আমি গোশালার ভার দিয়েছি‌, সে গরু-মোষ নিয়ে আছে।’

‘আর অন্য দল?’

‘অন্য দলের অতীত জীবনে দাগ আছে। যেমন ধরুন‌, ভূজঙ্গধরবাবু। এমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোক কম দেখা যায়। ডাক্তার ছিলেন‌, সাজারিতে অসাধারণ হাত ছিল; এমন কি প্ল্যাস্টিক সাজারি পর্যন্ত জানতেন। কিন্তু তিনি এমন একটি দুনৈতিক কাজ করেছিলেন যে তাঁর ডাক্তারির লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি এখন কলোনীর ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডার হয়ে আছেন।’

‘বুঝেছি। তারপর বলুন।’

ব্যোমকেশ অতিথির সম্মুখে সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিল‌, কিন্তু তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন,–’ব্লাড-প্রেসার বাড়ার পর ছেড়ে দিয়েছি।’ তারপর তিনি ধীরে অত্বরিত কণ্ঠে বলিতে শুরু করিলেন,–’কলোনীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনও নূতনত্ব নেই‌, দিনের পর দিন একই কাজের পুনরাভিনয় হয়। ফুল ফোটে‌, শাকসবজি গজায়‌, মুগী ডিম পাড়ে‌, দুধ থেকে ঘি মাখন তৈরি হয়। কলোনীর একটা ঘোড়া-টানা ভ্যান আছে‌, তাতে বোঝাই হয়ে রোজ সকালে মাল স্টেশনে যায়। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসে। মূনিসিপাল মার্কেটে আমাদের দুটো স্টল আছে‌, একটাতে ফুল বিক্রি হয়‌, অন্যটাতে শাকসবজি। এই ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তাতে ভালভাবেই চলে যায়।

‘এইভাবে চলছিল‌, হঠাৎ মাস ছয়েক আগে একটা ব্যাপার ঘটল। রাত্রে নিজের ঘরে ঘুমচ্ছিলাম‌, জানালার কাচ ভাঙার ঝনঝনি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে আলো জ্বেলে দেখি মেঝের ওপর পড়ে আছে—মোটরের একটি স্পার্কিং প্লাগ।’

আমি বলিয়া উঠিলাম্‌,–’স্পর্কিং প্লাগ।।’

নিশানাথ বলিলেন,–’হ্যাঁ। বাইরে থেকে কেউ ওটা ছুঁড়ে মেরে জানালার কাচ ভেঙেছে। শীতের অন্ধকার রাত্রি‌, কে এই দুষ্কার্য করেছে জানা গেল না। ভাবলাম‌, বাইরের কোনও দুষ্ট লোক নিরর্থক বজ্জাতি করেছে। গোলাপ কলোনীর কম্পাউন্ডের মধ্যে আসা-যাওয়ার কোনও অসুবিধা নেই‌, গরু-ছাগল আটকাবার জন্যে ফটকে আগড় আছে বটে‌, কিন্তু মানুষের যাতায়াতের পক্ষে সেটা গুরুতর বাধা নয়।

‘এই ঘটনার পর দশ-বারো দিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। তারপর একদিন সকালবেলা সদর দরজা খুলে দেখি দরজার বাইরে একটা ভাঙা কারবুরেটার পড়ে রয়েছে। তার দু’হগুী পরে এল একটা মোটর হর্ন। তারপর ছেড়া মোটরের টায়ার। এইভাবে চলেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’মনে হচ্ছে টুকরো টুকরো ভাবে কেউ আপনাকে একখানি মোটর উপহার দেবার চেষ্টা করছে। এর মানে কি বুঝতে পেরেছেন?

এতক্ষণে নিশানাথবাবুর মুখে একটু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করিলাম। তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন,–’পাগলের রসিকতা হতে পারে।–কিন্তু আমার এ অনুমান আমার নিজের কাছেও সন্তোষজনক নয়। তাই আপনার কাছে এসেছি।’

ব্যোমকেশ কিয়াৎকাল ঊর্ধ্বমুখ হইয়া ঘুরন্তু পাখার দিকে চাহিয়া রহিল‌, তারপর প্রশ্ন করিল,–’শেষবার মোটরের ভগ্নাংশ কবে পেয়েছেন?’

0 Shares