চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’আগে একটা কথা বলুন। ব্লাড-প্রেসারের রুগী পায়ে মোজা পরলে ব্লাড-প্রেসার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কি?’

ডাক্তার পাল বলিলেন,–’তা আছে। কিন্তু মাথার শিরা ছিঁড়ে মারা যাবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বিশেষ ক্ষেত্রে মারা যেতে পারে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ডাক্তারবাবু্‌, আপনি স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেবেন না। নিশানাথবাবুর শরীরের মধ্যে কী ঘটেছে বাইরে থেকে হয়তো সব বোঝা যাচ্ছে না। পোস্ট-মর্টেম হওয়া উচিত।’

ডাক্তার তীক্ষ্ণ চক্ষে কিছুক্ষণ ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিলেন‌, তারপর কলমের মাথা বন্ধ করিতে করিতে বলিলেন,–’আপনি ধোঁকা লাগিয়ে দিলেন। বেশ‌, তাই ভালো‌, ক্ষতি তো আর কিছু হবে না।’ ব্যাগ হাতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন,–’আমি চললাম। থানায় খবর পাঠাব‌, আর অটপ্সির ব্যবস্থা করব।’

ডাক্তার বিদায় দিয়া বিজয় ফিরিয়া আসিল‌, ক্লান্তভাবে একটা চেয়ারে বসিয়া দুহাতে মুখ ঢাকিল।

ভূজঙ্গধরবাবু তখনও ভিতর দিকের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ছিলেন, সদয় কণ্ঠে বলিলেন,–’বিজয়বাবু্‌, আপনি নিজের কুঠিতে গিয়ে শুয়ে থাকুন। আমি না হয় একটা সেডেটিভ্‌ দিচ্ছি। এ সময় ভেঙে পড়লে তো চলবে না।’

বিজয় হাতের ভিতর হইতে মুখ তুলিল না‌, রুদ্ধস্বরে বলিল,–’আমি ঠিক আছি।’

ভুজঙ্গধরবাবুর মুখে একটু ক্ষুব্ধ অসন্তোষ ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,–’নিশানাথবাবুও ঐ কথা বলতেন। শরীরে রোগ পুষে রেখেছিলেন‌, ওষুধ খেতেন না। আমি রক্ত বার করবার জন্য পীড়াপীড়ি করলে বলতেন‌, দরকার নেই‌, আমি ঠিক আছি। তার ফল দেখছেন তো?’

ব্যোমকেশ চট্‌ করিয়া তাঁহার দিকে ঘাড় ফিরাইল,–’তাহলে আপনিও বিশ্বাস করেন এটা স্বাভাবিক মৃত্যু?’

ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—’আমার বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই। আপনাদের সন্দেহ হয়েছে পরীক্ষা করিয়ে দেখুন। কিন্তু কিছু পাওয়া যাবে না।’

‘পাওয়া যাবে না কি করে জানলেন?’

ভুজঙ্গধরবাবু একটু মলিন হাসিলেন। ‘আমিও ডাক্তার ছিলাম একদিন।’ বলিয়া ধীরে ধীরে ভিতর দিকে প্ৰস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ বিজয়ের দিকে ফিরিয়া বলিল,–’ভুজঙ্গধরবাবু ঠিক বলেছেন‌, আপনার বিশ্রাম দরকার—‘

বিজয় কাতর মুখ তুলিয়া বলিল,–’আমি এখন শুয়ে থাকতে পারব না‌, ব্যোমকেশবাবু। কাকা—’ তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল।

‘তা বটে। আচ্ছা‌, তাহলে বলুন কাল থেকে কি কি ঘটেছে। কাল সকলে আপনি আমাকে চিঠি দিয়ে দোকানো গেলেন। ভাল কথা‌, আপনার কাকা আমাকে কি লিখেছিলেন। আপনি জানেন?’

‘না। কি লিখেছিলেন?’

‘লিখেছিলেন আমার সাহায্য আর তাঁর দরকার নেই। কিন্তু ওকথা যাক। আপনি কলকাতা থেকে ফিরলেন। কখন?’

‘পাঁচটার গাড়িতে।’

‘কাকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’

‘কাকা বাগানে বেড়াচ্ছেন দেখেছিলাম। কথা হয়নি।’

‘শেষ তাঁকে কখন দেখেছিলেন?’

‘সেই শেষ‌, আর দেখিনি। সন্ধ্যের পর আমি এখানে আসছিলাম। কাকার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে কিন্তু বাইরে থেকে শুনতে পেলাম রসিকাবাবুর সঙ্গে কাকার বাচসা হচ্ছে—‘

‘রসিকবাবু? যিনি শাকসবজির দোকান দেখেন? তাঁর সঙ্গে কী নিয়ে বাচসা হচ্ছিল?’

‘সব কথা শুনতে পাইনি। কেবল কাকা বলছিলেন শুনতে পেলাম—তোমাকে পুলিসে দেব। আমি আর ভেতরে এলাম না‌, ফিরে গেলাম।’

‘হুঁ। রাত্রে খাবার সময় কাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?’

‘না। আমি—সকাল সকাল খেয়ে আবার আটটার ট্রেনে কলকাতায় গিয়েছিলাম।’

‘আবার কলকাতায় গিয়েছিলেন?’ ব্যোমকেশ স্থির নেত্ৰে বিজয়ের পানে চাহিয়া রহিল।

বিজয়ের শুষ্ক মুখ যেন আরও ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল। সে একটু বিদ্রোহের সুরে বলিল,–’হ্যাঁ। আমার দরকার ছিল।’

কী দরকার ছিল এ প্রশ্ন ব্যোমকেশ করিল না। শান্তস্বরে বলিল,–’কখন ফিরলেন?’

‘বারোটার পর। নিজের কুঠিতে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে মুকুল এসে—‘

‘মুকুল?’

‘মুকুল ভোরবেলা এদিক দিয়ে যাচ্ছিল‌, কাকিমার চীৎকার শুনতে পেয়ে ছুটে এসে দেখল কাকিমা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন আর কাকা মারা গেছেন। তখন মুকুল দৌড়ে গিয়ে আমাকে তুলল।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট মুখে দিতে গিয়া থামিয়া গেল‌, সিগারেট আবার কোটায় রাখিতে রাখিতে বলিল,–’রসিকবাবু কোথায়?’

বিজয় বলিল,–’রসিকবাবুকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর কুঠি খালি পড়ে আছে।’

‘তাই নাকি?’

এই সময় ব্ৰজদাস কথা বলিলেন। তিনি এতক্ষণ জানালায় ঠেস দিয়া নীরবে সমস্ত শুনিতেছিলেন‌, এখন গলা খাঁকারি দিয়া বলিলেন,–’রসিকবাবু বোধহয় কাল রাত্রেই চলে গেছেন। ওঁর কুঠি আমার পাশেই রাত্রে ওঁর ঘরে আলো জ্বলতে দেখিনি।’

বিজয় বলিল,–’তা হবে। হয়তো কাকার সঙ্গে বকবকির পর—‘

ব্যোমকেশ বলিল, —’হয়তো ফিরে আসবেন। কলোনীর আর সবাই যথাস্থানে আছে তো? নেপালবাবু—‘

‘আর সকলেই আছে।’

আবার কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। তারপর ব্যোমকেশ বলিল,–’বিজয়বাবু্‌, এবার বলুন দেখি‌, নিশানাথবাবুর মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয় এ সন্দেহ আপনার হল কেন?’

বিজয় বলিল,–’প্রথমে ওঁর পায়ে মোজা দেখে। কাকা শীতকালেও মোজা পরতেন না‌, মোজা তাঁর ছিলইনা। দ্বিতীয়ত‌, আমি ঘরে ঢুকে দেখলাম জানালা বন্ধ রয়েছে।’

‘বন্ধ রয়েছে?’

‘হ্যাঁ‌, ছিটিকিনি লাগানো। কাকা কখনই রাত্রে জানালা বন্ধ করে শোননি। তবে কে জানালা বন্ধ করলে?’

‘তা বটে।–বিজয়বাবু্‌, আপনাকে একটা ঘরের কথা জিগ্যেস করছি‌, কিছু মনে করবেন না। আপনার কাকার জীবনে কি কোনও গোপন কথা ছিল?’

0 Shares