বিজয়ের চোখের মধ্যে যেন ভয়ের ছায়া পড়িল, সে অস্পষ্ট স্বরে বলিল,–’গোপন কথা! না, আমি কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’না জানা আশ্চর্য নয়। হয়তো তাঁর যৌবনকালে কিছু ঘটেছিল। কিন্তু কোনও দিন সন্দেহও কি হয়নি?’
‘না।’ বলিয়া বিজয় ক্লান্তভাবে দুহাতে মুখ ঢাকিল।
এই সময় দেখিলাম। বৈষ্ণব ব্ৰজদাস কখন নিঃসাড়ে ঘর হইতে অন্তর্হিত হইয়াছেন। আমাদের মনোযোগ বিজয়ের দিকে আকৃষ্ট ছিল বলিয়াই বোধহয় তাঁহার নিষ্ক্রমণ লক্ষ্য করি নাই।
ভিতর দিকের দ্বারা দিয়া ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়া আমাদের মধ্যে দাঁড়াইলেন, খাটো গলায় বলিলেন,–’মিসেস সেনের জ্ঞান হয়েছে।’
বিজয় ধড়মড় করিয়া উঠিয়া গমনোদ্যত হইল। ভুজঙ্গধরবাবু তাহাকে ক্ষণেকের জন্য আটকাইলেন, বলিলেন,–’পোস্ট-মর্টেমের কথা এখন মিসেস সেনকে না বলাই ভাল।’
বিজয় চলিয়া গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই দময়ন্তী দেবীর ঘর হইতে মমন্তিক কান্নার আওয়াজ আসিল।
‘কাকিমা–।’
‘বাবা বিজয়–?’
ভুজঙ্গধরবাবু একটা অর্ধোচ্ছ্বসিত নিশ্বাস চাপিয়া যো-পথে আসিয়াছিলেন সেই পথে ফিরিয়া গেলেন। আমরা নেপথ্য হইতে দুইটি শোকার্ত মানুষের বিলাপ শুনিতে লাগিলাম।
১১
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাড়ে ন’টা। এখনও পুলিস আসতে অনেক দেরি। চল একটু ঘুরে আসা যাক।’
‘কোথায় ঘুরবে?’
‘কলোনীর মধ্যেই এদিক ওদিক। এস।’
দু’জনে বাহির হইলাম। দময়ন্তী দেবীর কান্নাকাটির শব্দ এখনও থামে নাই। বিজয় কাকিমার কাছেই আছে। ভুজঙ্গধরবাবুরাও বোধহয় উপস্থিত আছেন।
আমরা সদর দরজা দিয়া বাহির হইলাম। বাঁ-হাতি পথ ধরিয়াছি, কয়েক পা। যাইবার পর একটা দৃশ্য দেখিয়া থমকিয়া গেলাম। বাড়ির এ-পাশে কয়েকটা কামিনী ফুলের ঝাড় বাড়ির দু’টি জানালাকে আংশিকভাবে আড়াল, করিয়া রাখিয়াছে। দু’টি জানালার আগেরটি নিশানাথবাবুর ঘরের জানালা, পিছনেরটি দয়মন্তী দেবীর ঘরের। দেখিলাম, দয়মন্তী দেবীর জানালার ঠিক নীচে একটি স্ত্রীলোক সম্মুখদিকে ঝুকিয়া একাগ্ৰ ভঙ্গীতে দাঁড়াইয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সে চকিতে মুখ তুলিল এবং সরীসৃপের মত ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়া বাড়ির পিছনে অদৃশ্য হইল।
মুস্কিলের বৌ নজর বিবি।
ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া চাহিয়া ছিল। বলিলাম,–’দেখলে?’
ব্যোমকেশ আবার চলিতে আরম্ভ করিয়া বলিল,–’জানালায় আড়ি পেতে শুনছিল।’
‘কি মতলবে?’
‘নিছক কৌতুহল হতে পারে। মেয়েমানুষ তো! নিশানাথবাবু মারা গেছেন। অথচ ওরা বিশেষ কোনও খবর পায়নি। সরাসরি জিজ্ঞেস করবারও সাহস নেই। তাই হয়তো–’
আমার মনঃপূত হইল না। মেয়েরা কৌতুহলের বশে আড়ি পাতিয়া থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কি শুধুই কৌতুহল?
গোেহালের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় দেখিলাম পানুগোপাল নিজের কুঠির পৈঠায় বসিয়া হতাশা-ভরা চক্ষে আকাশের দিকে চাহিয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল, দু’ হাতে নিজের চুলের মুঠি ধরিয়া কিছু বলিতে চাহিল। তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বাহির হইল না। তারপর সে আবার বসিয়া পড়িল। এই অসহায় মানুষটি নিশানাথবাবুর মৃত্যুতে কতখানি কাতর হইয়াছে একটি কথা না বলিয়াও তাহা প্রকাশ করিল।
আমরা দাঁড়াইলাম না, আগাইয়া চলিলাম। সামনের একটা মোড় ছাড়িয়া দ্বিতীয় মোড় ঘুরিয়া নেপালবাবুর গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম।
নেপালবাবু অধোিলঙ্গ অবস্থায় তক্তপোশে বসিয়া একটা বাঁধানো খাতায় কিছু লিখিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া দ্রুত খাতা বন্ধ করিয়া ফেলিলেন। চোখ পাকাইয়া আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন,–’আপনারা!’
ব্যোমকেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া তক্তপোশের পাশে বসিল, দুঃখিত মুখে মিথ্যা কথা বলিল,–’নিশানাথবাবু চিঠি লিখে নেমস্তন্ন করেছিলেন। আজ এসে দেখি–এই ব্যাপার।’
নেপালবাবু সতর্ক চক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া গলার মধ্যে একটা শব্দ করিলেন এবং অর্ধদগ্ধ সিগার ধরাইতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল,—’আমরা তো একেবারে ঘাবড়ে গেছি। নিশানাথবাবু এমন হঠাৎ মারা যাবেন ভাবতেই পারিনি।’
নেপালবাবু ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিলেন,–’ব্লাডুপ্রেসারের রুগী ঐভাবেই মরে। নিশানাথ বড় একগুঁয়ে ছিল, কারুর কথা শুনতো না। কতবার বলেছি—’
‘আপনার সঙ্গে তো তাঁর খুবই সদ্ভাব ছিল?’
নেপালবাবু একটু দাম লইয়া বলিলেন,–’হ্যাঁ, সদ্ভাব ছিল বৈকি। তবে ওর একগুঁয়েমির জন্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হত।’
‘কথা কাটাকাটির কথায় মনে পড়ল। সেদিন আমাদের সামনে আপনি ওঁকে বলেছিলেন, ভাঙব নাকি হাঁটে হাঁড়ি! তা থেকে আমার মনে হয়েছিল, আপনি ওঁর জীবনের কোনও গুপ্তকথা জানেন।‘
নেপালবাবুর এবার আর একটু ভাব-পরিবর্তন হইল, তিনি সৌহৃদ্যসূচক হাসিলেন। বলিলেন,–’গুপ্তকথা! আরে না, ও আপনার কল্পনা। রাগের মাথায় যা মুখে এসেছিল বলেছিলাম, ওর কোনও মানে হয় না।–তা আপনারা এসেছেন, আজ তো এখানে খাওয়া-দাওয়ার কোন ব্যবস্থাই নেই, হবে বলেও মনে হয় না। মুকুল—আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’হবারই কথা। উনিই তো প্রথম জানতে পারেন। খুবই শক লেগেছে। —আচ্ছা নেপালবাবু্, কিছু মনে করবেন না, একটা প্রশ্ন করি। আপনার মেয়ের সঙ্গে কি বিজয়বাবুর কোনও রকম—‘
নেপালবাবুর সুর আবার কড়া হইয়া উঠিল,–’কোনও রকম কী?’
‘কোনও রকম ঘনিষ্ঠতা–?’
‘কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার মেয়ে আমার নয়। তবে-প্রথম এখানে আসার কয়েকমাস পরে বিজয়ের সঙ্গে মুকুলের বিয়ের কথা তুলেছিলাম। বিজয় প্রথমটা রাজী ছিল, তারপর উলটে গেল।’ কিছুক্ষণ গুম হইয়া থাকিয়া বলিলেন,–’বিজয়টা ঘোর নির্লজ্জ।’