চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিল,–’বিজয়বাবুর কি চরিত্রের দোষ আছে?’

নেপালবাবু বলিলেন,–’দোষ ছাড়া আর কি। স্বভাবের দোষ। ভাল মেয়ে ছেড়ে যারা নষ্ট-কুলটার পেছনে ঘুরে বেড়ায় তাদের কি সচ্চরিত্র বলব?’

বিজয়-মুকুলঘটিত রহস্যটি পরিষ্কার হইবার উপক্রম করিতেছিল‌, কিন্তু বাধা পড়িল। ভুজঙ্গাধর বাবু প্ৰবেশ করিয়া বলিলেন,–’মুকুল এখন কেমন আছে?’

নেপালবাবু বলিলেন,–যেমন ছিল তেমনি। নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুমি একবার দেখবে?’

‘চলুন। কোথায় সে?’

‘শুয়ে আছে।’ বলিয়া নেপালবাবু তক্তপোশ হইতে উঠিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,–’আচ্ছা‌, আমরাও তাহলে উঠি!’

নেপালবাবু উত্তর দিলেন না‌, ভুজঙ্গধরবাবুকে লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন।

খাতাটা তক্তপোশের উপর পড়িয়া ছিল। ব্যোমকেশ টপ করিয়া সেটা তুলিয়া লইয়া দ্রুত পাতা উল্টাইল‌, তারপর খাতা যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া বলিল,–’চল।’

বাহিরে রাস্তায় আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–’খাতায় কী দেখলে?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’বিশেষ কিছু নয়। কলোনীর সকলের নামের ফিরিস্তি। তার মধ্যে পানুগোপাল আর বনলক্ষ্মীর নামের পাশে ঢ্যারা।’

‘তার মানে?’

নেপালবাবু বোধহয় কালনেমির লঙ্কাভাগ শুরু করে দিয়েছেন। ওঁর ধারণা হয়েছে উনিই এবার কলোনীর শূন্য সিংহাসনে বসবেন। পানুগোপাল আর বনলক্ষ্মীকে কলোনী থেকে তাড়াবেন‌, তাই তাদের নামে ঢ্যারা পড়েছে। কিন্তু ওকথা যাক‌, মুকুল আর বিজয়ের ব্যাপার বুঝলে?’

‘খুব স্পষ্টভাবে বুঝিনি। কী ব্যাপার?’

‘নেপালবাবুরা কলোনীতে আসার পর মুকুলের সঙ্গে বিজয়ের মাখামাখি হয়েছিল‌, বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। তারপর এল। বনলক্ষ্মী। বনলক্ষ্মীকে দেখে বিজয় তার দিকে বুকল‌, মুকুলের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দিলে।’

‘ও—তাই নষ্ট-কুলটার কথা। কিন্তু বিজয়ও তো বনলক্ষ্মীর ইতিহাস জানে। প্রেম হলেও বিয়ে হবে কি করে?’

‘বিজয় যদি জেনেশুনে বিয়ে করতে চায় কে বাধা দেবে?’

‘নিশানাথবাবু নিশ্চয় বাধা দিয়েছিলেন।’

‘সম্ভব। তিনি বনলক্ষ্মীকে স্নেহ করতেন। কিন্তু তার সঙ্গে ভাইপোর বিয়ে দিতে বোধহয় প্ৰস্তুত ছিলেন না। —বড় জটিল ব্যাপার অজিত‌, যত দেখছি ততাই বেশি জটিল মনে হচ্ছে। নিশানাথবাবুর মৃত্যুতে অনেকেরই সুবিধা হবে।’

‘নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। এ বিষয়ে তুমি নিঃসংশয়?’

‘নিঃসংশয়। তাঁর ব্লাড-প্রেসার তাঁকে পাহাড়ের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল‌, তারপর পিছন থেকে কেউ ঠেলা দিয়েছে।’

নিশানাথবাবুর বাড়িতে ফিরিয়া আসিলে বিজয় বলিল,–’কাকিমাকে ভুজঙ্গধরবাবু্‌, মরফিয়া ইনজেকশন দিয়েছেন। কাকিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ভাল। ঘুম ভাঙলে অনেকটা শান্ত হবেন। ইতিমধ্যে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা যাবে।’

১২

এগারোটার সময় পুলিস ভ্যান আসিল। তাঁহাতে কয়েকজন কনস্টেবল ও স্থানীয় থানার দারোগা প্ৰমোদ বরাট।

প্রমোদ বরাটের বয়স বেশি নয়। কালো রঙ‌, কাটালো মুখ‌, শালপ্রাংশু দেহ। পুলিসের ছাঁচে পড়িয়াও তাহার মনটা এখনও শক্ত হইয়া ওঠে নাই; মুখে একটু ছেলেমানুষী ভাব এখনও লাগিয়া আছে। করজোড়ে ব্যোমকেশকে নমস্কার করিয়া তদগত মুখে বলিল,–’আপনিই ব্যোমকেশবাবু?’

বুঝিলাম পুলিসের লোক হইলেও সে ব্যোমকেশের ভক্ত। ব্যোমকেশ হাসিমুখে তাহাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া নিশানাথবাবুর মৃত্যুর সন্দেহজনক হাল বয়ান করিল। প্রমোদ বরাট একাগ্রমনে শুনিল। তারপর ব্যোমকেশ তাঁহাকে লইয়া মৃতের কক্ষে প্রবেশ করিল। বিজয় ও আমি সঙ্গে গেলাম।

ঘরে প্রবেশ করিয়া বরাট দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া পড়িল এবং চারিদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল। এই সময় মেঝের উপর একটা লঘু গোলক বাতাসে গড়াইতে গড়াইতে যাইতেছে দেখিয়া বরাট নত হইয়া সেটা কুড়াইয়া লইল। খড়‌, শুকনা ঘাস‌, শণের সুতো মিশ্রিত একটি গুচ্ছ। বরাট বলিল,–’এটা কি? কোখেকে এল?’

ব্যোমকেশ বলিল, —’চড়াই পাখির বাসা। ঐ দেখুন‌, ওখান থেকে খসে পড়েছে।’ বলিয়া ঊর্ধ্বে পাখা ঝুলাইবার আংটার দিকে দেখাইল। দেখা গেল চড়াই পাখিরা নির্বিকার‌, শূন্য আংটায় আবার বাসা বাঁধতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।

খড়ের গোলাটা ফেলিয়া দিয়া বরাট মৃতদেহের কাছে গিয়া দাঁড়াইল এবং চাদর সরাইয়া মৃতদেহের উপর চোখ বুলাইল। ব্যোমকেশ বলিল,–’পায়ে মোজা দেখছেন? ঐটেই সন্দেহের মূল কারণ। আমি মৃতদেহ ছুইনি‌, পুলিসের আগে মৃতদেহ স্পর্শ করা অনুচিত হত। কিন্তু মোজার তলায় কী আঁছে‌, পায়ে কোনও চিহ্ন আছে কি না জানা দরকার।’

‘বেশ তো‌, এখনই দেখা যেতে পারে বলিয়া বরাট মোজা খুলিয়া লইল। ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া পায়ের গোছ পর্যবেক্ষণ করিল। আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় না‌, কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলে দেখা যায় পায়ের গোছের কাছে অল্প দাগ রহিয়াছে; মোজার উপর ইল্যাস্টিক গাটাির পরিলে যে-রকম দাগ হয়। সেই রকম।

দাগ দেখিয়া ব্যোমকেশের চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছিল; সে বরাটকে বলিল,–’দেখলেন?’

বরাট বলিল,–’হ্যাঁ। বাঁধনের দাগ মনে হয়। কিন্তু এ থেকে কী অনুমান করা যেতে পারে?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’অন্তত এটুকু অনুমান করা যেতে পারে যে‌, নিশানাথবাবু মৃত্যুর পূর্বে নিজে মোজা পারেননি‌, আর কেউ পরিয়েছে।’

বরাট বলিল,–’কিন্তু কেন? এর থেকে কি মনে হয়? আপনি বুঝতে পেরেছেন?’

‘বোধহয় পেরেছি। কিন্তু যতক্ষণ শব পরীক্ষা না হচ্ছে ততক্ষণ কিছু না বলাই ভাল। আপনি মৃতদেহ নিয়ে যান। ডাক্তারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে বলবেন গায়ে কোথাও হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের চিহ্ন আছে কি না।’

0 Shares