চিড়িয়াখানা

‘বেশ।’

আমরা আবার বাহিরের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। বরাট কনস্টেবলদের ডাকিয়া মৃতদেহ ভ্যানে তুলিবার হুকুম দিল। বিজয় এতক্ষণ কোনও মতে নিজেকে শক্ত করিয়া রাখিয়াছিল‌, এখন মুখে হাত চাপা দিয়া কাঁদিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ কোমল স্বরে বলিল,–’আপনার আজ আর সঙ্গে গিয়ে কাজ নেই‌, আমরা যাচ্ছি। আপনি বরং কাল সকালে যাবেন।–কি বলেন‌, ইন্সপেক্টর বরাট?’

বরাট বলিল,–’সেই ভাল। কাল সকালের আগে রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। আমি সকালে ওঁকে নিয়ে আপনার বাসায় যাব।’

‘বেশ। চলুন তাহলে। আপনার ভ্যানে আমাদের জায়গা হবে তো?’

‘হবে। আসুন।’

ব্যোমকেশ বিজয়ের পিঠে হাত রাখিয়া মৃদুস্বরে আশ্বাস দিল‌, তারপর আমরা দ্বারের দিকে পা বাড়াইলাম। এই সময় ভিতরের দরজার সম্মুখে বনলক্ষ্মী আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ শুষ্ক শ্ৰীহীন‌, পরনের ময়লা শাড়ির আঁচলে কালি ও হলুদের ছোপ। আমাদের সহিত চোখাচোখি হইতে সে বলিল,–’রান্না হয়েছে। আপনারা খেয়ে যাবেন না?’

ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল,–’রান্না! কে রাঁধলে?’

বনলক্ষ্মী চোখ নামাইয়া সঙ্কুচিত স্বরে বলিল,–’আমি।’

তাহার আঁচলে কালি ও হলুদের দাগ‌, অনভ্যস্ত রন্ধনক্রিয়ার চিহ্ন। যাক‌, তবু কলোনীর একজন মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়াছে‌, যত মমস্তিক ঘটনাই ঘটুক এতগুলো লোকের আহার চাই তাহা সে ভোলে নাই। দেখিলাম‌, বিজয় মুখ তুলিয়া একদৃষ্টি কনলক্ষ্মীর পানে চাহিয়া আছে‌, যেন তাহাকে এই নূতন দেখিল।

ব্যোমকেশ বলিল,–’আমরা এখন ফিরে যাচ্ছি। খাওয়া থাক। এমনিতেই আপনাদের কষ্টের শেষ নেই‌, আমরা আর হাঙ্গামা বাড়ব না। আপনি বরং এদের ব্যবস্থা করুন।’ বলিয়া বিজয়ের দিকে ইঙ্গিত করিল।

বনলক্ষ্মী বিজয়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল‌, ভারী গলায় বলিল,–’চলুন‌, স্নান করে নেবেন।’

আমরা বাহির হইলাম।

পুলিস ভ্যান একটি শবদেহ ও কয়েকটি জীবন্ত মানুষ লইয়া কলিকাতার অভিমুখে চলিল। পথে বেশি কথা হইল না। এক সময় ব্যোমকেশ বলিল, —’রসিক দে নামে একটি লোক কলোনীতে থাকত‌, কাল থেকে সে নিরুদ্দেশ। খুব সম্ভব দোকানের টাকা চুরি করেছে। তার খোঁজ নেবেন। তার হাতের আঙুল কাটা। খুঁজে বার করা কঠিন হবে না।’

বরাট নোটবুকে লিখিয়া লইল।

ঘণ্টাখানেক পরে বাসার সম্মুখে আমাদের নামাইয়া দিয়া পুলিস ভ্যান চলিয়া গেল।

সময় দিন ফটা বিভ্রান্ত হইয়া বহিল। নিশানাথবাবুর ছায়ামূর্তি মনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

বিকালবেলা তিনটার সময় দেখিলাম ব্যোমকেশ ছাতা লইয়া বাহির হইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম,–’কোথায়?’

সে বলিল,–’একটু খোঁজ-খবর নিতে বেরুচ্ছি।’

‘কার খোঁজ-খবর?’

‘কারুর ওপর আমার পক্ষপাত নেই‌, কলোনীর অধিবাসীদের যার খবর পাব যোগাড় করব। আপাতত দেখি ডাক্তার ভুজঙ্গধর আর লাল সিং সম্বন্ধে কিছু সংগ্ৰহ করতে পারি। কিনা।’

‘লাল সিংকে ভোলোনি?’

‘কাউকে ভুলিনি।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিস্ক্রান্ত হইল।

সে বাহির হইবার আধা ঘন্টা পরে টেলিফোন আসিল। বিজয় কলোনী হইতে টেলিফোন করিতেছে। ওদিকের খবর ভালই‌, দময়ন্তী দেবী এখনও জাগেন নাই। অন্য খবরের মধ্যে ব্ৰজদাস গোঁসাইকে পাওয়া যাইতেছে না‌, দ্বিপ্রহরে আহারের পূর্বেই তিনি অন্তর্ধান করিয়াছেন।

অভিনব সংবাদ। প্রথম রসিক দে, তারপর বৈষ্ণব বাবাজী! ইনিও কি কলোনীর টাকা হাত সাফাই করিতেছিলেন?

ব্যোমকেশ ফিরিলে সংবাদ দিব বলিয়া টেলিফোন ছাড়িয়া দিলাম।

সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি নামিল। যেন অনেকদিন একজ্বরী ভোগ করিবার পর ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল। ব্যোমকেশ রৌদ্রের জন্য ছাতা লইয়া বাহির হইয়াছে‌, বৃষ্টিতেও ছাতা কাজে আসিবে।

রাত্রি সাড়ে আটটার সময় ব্যোমকেশ ফিরিল। জামা ভিজিয়া গোবর হইয়াছে‌, ছাতাটার অবস্থা ঝোড়ো কাকের মত; সেই অবস্থায় চেয়ারে বসিয়া পরম তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিল। তারপর গলা চড়াইয়া হাঁকিল,–’পুঁটিরাম‌, চা নিয়ে এস।’

তাহাকে বিজয়ের বার্তা শুনাইলাম। সে কিছুক্ষণ অন্যমনে রহিল‌, শেষে বলিল,–’একে একে নিভিছে দেউটি। এইভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত মুস্কিল মিঞা ছাড়া আর কেউ থাকবে না। কিন্তু বাবাজী এত দেরিতে পালালেন কেন? পোস্ট-মর্টেমের নাম শুনে ঘাবড়ে গেছেন?’

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’তারপর তোমার কি হল? ভুজঙ্গধরবাবুর খবর পেলে?’

‘নতুন খবর বড় কিছু নেই। তিনি যা যা বলেছিলেন সবই সত্যি। চীনেপট্টিতে তাঁর ডিসপেন্সারি আর নার্সিং হোম ছিল। অনেক রোজগার করতেন! তারপরই দুর্মতি হল।’

‘আর লাল সিং?’

ব্যোমকেশ ভিজা জামা খুলিয়া মাটিতে ফেলিল,–’লাল সিং বছর দুই আগে জেলে মারা গেছে। তার স্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চিঠি ফিরে এসেছে। স্ত্রীর পাত্তা কেউ জানে না।‘

বাহিরে বৃষ্টি চলিতেছে; চারিদিক ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। পুঁটিরাম চা আনিয়া দিল। ব্যোমকেশ চায়ে একটি ক্ষুদ্র চুমুক দিয়া বলিল,–’এই বৃষ্টিটা যদি কাল রাত্তিরে হত তাহলে নিশানাথবাবুর মোজা পরার একটা মানে পাওয়া যেত‌, মনে হত উনি নিজেই মোজা পরেছেন। অন্তত সম্ভাবনাটা বাদ দেওয়া যেত না। ভাগ্যিস কাল বৃষ্টি হয়নি।’

১৩

পরদিন সকালবেলা বরাট ও বিজয় আসিল। বিজয়ের পা খালি‌, অশোচের বেশ। ক্লান্তভাবে চেয়ারে বসিল।

ব্যোমকেশ বরাটের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল,–’কৈ‌, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট দেখি।’

বোতাম-অ্যাটা পকেট খুলিতে খুলিতে বরাট বলিল,–’পরিষ্কার রিপোর্ট; সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। রক্তে কোনও বিষ বা ওষুধের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মাথার মধ্যে হেমারেজ হয়ে মারা গেছেন।’

0 Shares