চিড়িয়াখানা

‘হুঁ। এবং সেজন্যেই ওর ভয় হয়েছে।’

কিছুক্ষণ কাটিবার পর আবার প্রশ্ন করিলাম,–’আচ্ছা‌, মোটরের টুকরো পাঠানোর সঙ্গে নিশানাথবাবুর মৃত্যুর কি কোনও সম্বন্ধ আছে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘থাকতেও পারে‌, না থাকতেও পারে।’

‘লাল সিং তো দু’ বছর আগে মরে গেছে। নিশানাথবাবুকে তবে মোটরের টুকরো পাঠাচ্ছিল কে?’

‘তা জানি না। কিন্তু একটা ভুল কোরো না। মোটরের টুকরোগুলো যে নিশানাথবাবুর উদ্দেশ্যেই পাঠানো হচ্ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। তিনি নিজে তাই মনে করেছিলেন বটে‌, কিন্তু তা না হতেও পারে।’

‘তবে কার উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না। দুই-তিন মিনিট অপেক্ষা করিয়া যখন দেখিলাম উত্তর দিবে না‌, তখন অন্য প্রশ্ন করিলাম,–’সুনয়না-উপাখ্যানের সঙ্গে নিশানাথবাবুর মৃত্যুর যোগাযোগ আছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘থাকলেও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মুরারি দত্তকে মেরেছিল সুনয়না নিকোটিন বিষ খাইয়ে। নিশানাথবাবুকে মেরেছে পুরুষ।’

‘পুরুষ?’

‘হ্যাঁ। নিশানাথবাবু লম্বা-চওড়া লোক ছিলেন না‌, তবু তাঁকে দড়ি দিয়ে কড়িকাঠ থেকে বুলিয়ে দেওয়া একজন স্ত্রীলোকের কর্ম নয়।’

‘তা বটে। কিন্তু মোটিভ কি হতে পারে?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া আলস্য ভাঙিল।

‘আমাকে নিশানাথবাবু ডেকেছিলেন‌, এইটেই হয়তো সবচেয়ে বড় মোটিভ!’ বলিয়া সে সিগারেট ধরাইয়া স্নানঘরের দিকে চলিয়া গেল।

১৪

সায়াহ্নে মোহনপুরের স্টেশনে যখন পৌঁছিলাম তখনও গ্ৰীষ্মের বেলা অনেকখানি বাকি আছে। স্টেশনের প্রাঙ্গণে বাহির হইয়া দেখি কিলোনীর গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে‌, মুস্কিল মিঞা পা-দানে বসিয়া বিড়ি টানিতেছে।

মুস্কিলকে এ কয়দিন দেখি নাই‌, সে যেন আর একটু বুড়ো হইয়া গিয়াছে‌, আরও ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। সেলাম করিয়া বলিল,–’বিজয়বাবু আপনাগোর জৈন্য গাড়ি পাঠাইছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ওরা ঘাট থেকে ফিরেছে তাহলে?’

মুস্কিল বলিল,–’হ-ফিরছেন।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’

মুস্কিল নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,–’আর নূতন খবর কী কতা। সব তো শেষ হইয়া গিছে।’

‘তা বটে। চলা-কিন্তু একবার থানা হয়ে যেতে হবে।’

‘চলেন।–কর্তাবাবুর নাকি ময়না তদন্ত হৈছে?’

‘হ্যাঁ। তুমি খবর পেলে কোত্থেকে?’

‘শুন শুন কানে আইল। তা ময়না তদন্তে কী জানা গেল? সহজ মৃত্যু নয়?’

ব্যোমকেশ প্রশ্নটা পাশ কাটাইয়া গেল। বলিল,–’সে কথা ডাক্তার জানেন। মুস্কিল মিঞা‌, তুমি তো আফিম খেয়ে ঝিমোও‌, তুমি এত খবর পাও কি করে?’

মুস্কিলের মুখে একটু ক্ষীণ হাসি দেখা দিল‌, সে বলিল–’আমি ঝিমাইলে কি হৈব কত‌, আমার বিবিজানাডার চারটা চোখ চারটা কানি। তার চোখ কান এড়ায়া কিছু হৈবার যো নাই। আমি সব খবর পাই। একটা কিছু যে ঘটবো তা আগেই বুঝছিলাম।’

‘কি করে বুঝলে?’

মুস্কিল একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ আক্ষেপভরে হস্তসঞ্চালন করিয়া বলিল,–’মেইয়া মানুষ লইয়া লট্‌খট্‌। রাতের আঁধারে এ উয়ার ঘরে যায়‌, ও ইয়ার ঘরে যায়–ই সব নষ্টামিতে কি ভাল হয় কর্তা? হয় না।’

বিস্মিতস্বরে ব্যোমকেশ বলিল,–’কে কার ঘরে যায়?’

কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মুস্কিল একটু বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিল‌, বলিল,–’কারে বাদ দিমু কর্তা? মেইয়া লোকগুলাই দুষ্ট হয় বেশি‌, মরদের সর্বনাশের জৈন্যই তো খোদা উয়াদের বানাইছেন।’

‘মানে…তুমি বলতে চাও রাত্রে কলোনীর মেয়েরা লুকিয়ে পুরুষদের ঘরে যায়। কে কার ঘরে যায় বলতে পার?’

‘তা কেমনে কৈব কর্তা? আঁধারে কি কারো মুখ দেখা যায়। তবে ভিতর ভিতর নষ্টামি চলছে। এখন কর্তাবাবু নাই‌, বড়বিবিও সাদাসিন্দা মেইয়া‌, এখন তো হন্দ বাড়াবাড়ি হৈব।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’মেয়েরা কারা তা না হয় বলতে পারলে না‌, কিন্তু কার ঘরে যায় সেটা তো বলতে পার।’

মুস্কিল একটু অধীরস্বরে বলিল,–’কি মুস্কিল‌, সেটা আন্দাজ কৈরা লন না। মেইয়া লোক জোয়ান মরদের ঘরে যাইব না তো কি বুড়ার ঘরে যাইব?’

মুস্কিল মিঞার জীবন-দর্শনে মার-প্যাচ নাই। মনে মনে হিসাব করিলাম‌, জোয়ান মরদের মধ্যে আছে বিজয়‌, রসিক‌, পানুগোপাল। ডাক্তার ভুজঙ্গাধরকেও ধরা যাইতে পারে।

ব্যোমকেশ আর প্রশ্ন করিল না‌, গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া বলিল,–’চল‌, এবার যাওয়া যাক। থানা কতদূর?’

‘কাছেই‌, রাস্তায় পড়ে।‘ মুস্কিল চালকের আসনে উঠিয়া গাড়ি হাঁকাইয়া দিল।

থানায় উপস্থিত হইলে প্রমোদ বরাট আমাদের খাতির করিয়া নিজের কুঠুরিতে বসাইল এবং সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিল। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া মৃদুহাস্যে বলিল,–’নিশানাথবাবুকে কেউ খুন করেছে এ প্রত্যয় আপনার হয়েছে?’

বরাট বলিল,—’আমার হয়েছে‌, কিন্তু কর্তারা তানানানা করছেন। তাঁরা বলেন‌, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে যখন কিছু পাওয়া যায়নি তখন ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ কি! আমি কিন্তু ছোড়ছি না‌, লেগে থাকব।–আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’সন্দেহ এখনও কারুর ওপর পড়েনি। কিন্তু এই ঘটনার একটা পটভূমিকা আছে‌, সেটা আপনার জানা দরকার। বলি শুনুন।’ বলিয়া সুনয়না ও মোটরের টুকরো সংক্রান্ত সমস্ত কথা বিবৃত করিল।

শুনিয়া বিরাট উত্তেজিত হইয়া উঠিল‌, বলিল,–’ঘোরালো ব্যাপার দেখছি। —আমাকে কী করতে হবে বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আপাতত দুটো কাজ করা দরকার। এক‌, কলোনীর সকলের হাতের টিপ নিতে হবে–’

‘তাতে কী লাভ?’

‘ওটা থাকা ভাল। কখন কি কাজে লাগবে বলা যায় না।’

বরাট একটু ইতস্তত করিয়া বলিল,–’কাজটা ঠিক আইনসঙ্গত হবে কিনা বলতে পারি না‌, তবু আমি করব। দ্বিতীয় কাজ কী?’

0 Shares