চিড়িয়াখানা

‘দ্বিতীয় কাজ‌, আমরা কলোনীতে যাচ্ছি‌, আপনিও চলুন। আপনার সামনে আমি কলোনীর প্ৰত্যেককে প্রশ্ন করব‌, আপনি শুনবেন এবং দরকার হলে নোট করবেন।’

‘কী ধরনের প্রশ্ন করবেন?’

‘আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হবে‌, সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কে কোথায় ছিল‌, কার অ্যালিবাই আছে। কার নেই‌, এই নির্ণয় করা।’

‘বেশ‌, চলুন তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক‌, কাজ সেরে ফিরতে হবে।’

টিপ লইবার সরঞ্জামসহ একজন হেড কনস্টেবল আমাদের সঙ্গে চলিল।

সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময় কলোনীতে পৌঁছিলাম। গত রাত্রির বর্ষণ এখানেও মাটি ভিজাইয়া দিয়া গিয়াছে। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভুজঙ্গধরবাবু বিজয়ের সহিত কথা বলিতেছিলেন। বিজয়ের মুখে এখনও শ্মশানবৈরাগ্যের ছায়া লাগিয়া আছে। ভুজঙ্গধরবাবুর মুখ কিন্তু প্ৰফুল্প্‌্‌, তাঁহার মুখে অমর সাক্ত একপেশে হাসি আবার ফিরিয়া আসিয়াছে।

আমাদের সঙ্গে প্রমোদ বরাট ও কনস্টেবলকে দেখিয়া বিজয়ের চোখে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল। ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,–’আসুন। বিজয়বাবুকে মোহমুদগর শোনাচ্ছি।–কা। তব কন্তু-নিলিনীদলগত-জলমতিতরলং–’

তাঁহার লঘুতা সময়োচিত নয়; মনে হইল বিজয়ের মন প্রফুল্ল করিবার জন্য তিনি আধিক্য দেখাইতেছেন।

করাট পুলিসী গাভীর্যের সহিত বলিল,–’আপনাদের সকলের হাতের টিপ দিতে হবে।’

বিজয়ের চোখের প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল‌, ভুজঙ্গধরবাবুও চিকিতভাবে চাহিলেন। ব্যোমকেশ ব্যাখ্যাচ্ছিলে বলিল,–’কলোনী থেকে যে-ভাবে একে একে লোক খসে পড়ছে‌, বাকিগুলি কতদিন টিকে থাকবে বলা যায় না। তাই সতর্কতা।’

বিজয় বুঝিল, —’বেশ তো-নিন।’ তাহার চোখের দৃষ্টি নীরবে প্রশ্ন করিতে লাগিল,–কেন? নতুন কিছু পাওয়া গেছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আশা করি কারুর আপত্তি হবে না। কারণ যিনি আপত্তি করবেন স্বভাবতাই তাঁর উপর সন্দেহ হবে। ভুজঙ্গধরবাবু্‌, আপনার আপত্তি নেই তো?’

‘বিন্দুমাত্র না। আসুন— বলিয়া তিনি অঙ্গুষ্ঠ বাড়াইয়া দিলেন।

বরাট কনস্টেবলকে ইঙ্গিত করিল‌, কনস্টেবল অঙ্গুষ্ঠের ছাপ তুলিতে প্ৰবৃত্ত হইল। ভুজঙ্গধরববাবু বাঁকা হাসিতে হাসিতে বলিলেন,–’দেখছি আমি ভুল করেছিলাম। আঙুলের ছাপ যখন নেওয়া হচ্ছে তখন লাস পরীক্ষায় কিছু পাওয়া গেছে।’

তাঁহার এই অর্ধ-প্রশ্নের জবাব কেহ দিল না। কাগজের উপর তাঁহার ও বিজয়ের নাম ও ছাপ লিখিত হইলে ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,–’আর কার কার ছাপ নিতে হবে বলুন‌, আমি কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’

বরাট বলিল,–’সকলের ছাপই নিতে হবে। মেয়ে পুরুষ কেউ বাদ যাবে না।’

‘মিসেস সেনেরও?’

‘হ্যাঁ‌, মিসেস সেনেরও?’

‘বেশ-আও সিপাহী।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আর একটা কথা। টিপ নেবার সময় সকলকে বলে দেবেন যেন আধ ঘন্টা পরে এই বাড়িতে আসেন। দু’চারটে প্রশ্ন করব।’

ভুজঙ্গধরবাবু কনস্টেবলকে লইয়া চলিয়া গেলেন। আমরা বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলাম। বিজয় আলো জ্বালিয়া দিল। ব্যোমকেশ বলিল,–’এ ঘরটা হোক ওয়েটিং রুম-যাঁরা সাক্ষী দিতে আসবেন তাঁরা এ ঘরে বসবেন। আর পাশের ঘরে আমরা বসব‌, প্ৰত্যেককে আলাদা ডেকে প্রশ্ন করা হবে। কি বলেন ইন্সপেক্টর বিরাট?’

বরাট বলিল, —’সেই ঠিক হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’তাহলে বিজয়বাবু্‌, ও ঘরে একটা টেবিল আর গোটকয়েক চেয়ার আনিয়ে দিন। আর কিছুর দরকার হবে না।’

বিজয় চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করিতে গেল। পনেরো মিনিট পরে ভুজঙ্গধরবাবু কনস্টেবলসহ ফিরিয়া আসিলেন‌, বলিলেন—’এই নিন; টিপ সই হয়ে গেছে। ন্যাপলা একটু গোলমাল করবার তালে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। —সকলকে বলে দিয়েছি‌, আধ ঘন্টার মধ্যে আসবে। আমিও আসছি হাত-মুখ ধুয়ে।’ বলিয়া তিনি প্ৰস্থান করিলেন।

১৫

নিশানাথ যে-কক্ষে শয়ন করিতেন সেই কক্ষে টেবিল পাতা হইয়াছে। টেবিলের দুই পাশে দুইটি চেয়ারে ব্যোমকেশ ও বিরাট‌, মাঝে একটি খালি চেয়ার। আমি দ্বারের কাছে টুল লইয়া বসিয়াছি‌, দুই ঘরের দিকেই আমার দৃষ্টি আছে। মাথার উপর উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলিতেছে।

প্রথমে দময়ন্তী দেবীকে ডাকা হইল। বিজয় তাঁহার হাত ধরিয়া ভিতরের ঘর হইতে লইয়া আসিল‌, তিনি শূন্য চেয়ারটিতে বসিলেন। বিধবার বেশ‌, দেহে অলঙ্কার নাই‌, মাথায় সিঁদুর নাই‌, সুন্দর মুখখানিতে মোমের মত ঈষদচ্ছ পাণ্ডুরতা। তিনি নতনেত্ৰে স্থির হইয়া রহিলেন।

বিজয় চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া তাঁহার দুই কাঁধের উপর হাত রাখিল‌, বলিল,–’আমি যদি এখানে থাকি আপনাদের আপত্তি হবে কি?’

ব্যোমকেশ একটু অনিচ্ছাভরে বলিল,–’থাকুন।’ তারপর কোমলকণ্ঠে দময়ন্তী দেবীকে দুই-চারিটি সহানুভুতির কথা বলিয়া শেষে বলিল,–’আমরা আপনাকে বেশি কষ্ট দেব না‌, শুধু দু’চারটে প্রশ্ন করব যার আপনি ছাড়া আর কেউ উত্তর দিতে পারবে না-আপনাদের বিয়ে হয়েছিল। কতদিন আগে?’

দময়ন্তী দেবীর নত চক্ষু ব্যোমকেশের মুখ পর্যন্ত উঠিয়া আবার নামিয়া পড়িল। করুণ মিনতিভরা দৃষ্টি, তবু যেন তাহার মধ্যে একটা সংকল্প রহিয়াছে। অতি মৃদুস্বরে বলিলেন,–’দশ বছর আগে।’

অতঃপর নিম্নরূপ সওয়াল জবাব হইল। দময়ন্তী দেবী আর দ্বিতীয়বার চক্ষু তুলিলেন না‌, নিম্নস্বরে সকল প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

ব্যোমকেশ : আপনাদের যখন বিয়ে হয় নিশানাথবাবু তখন চাকরিতে ছিলেন?

দময়ন্তী; না‌, তার পরে।

ব্যোমকেশ; কিন্তু কলোনী তৈরি হবার আগে?

দময়ন্তী : হ্যাঁ।

ব্যোমকেশ : তাহলে বিয়ের সময় নিশানাথবাবুর বয়স ছিল সাতচল্লিশ বছর?

0 Shares