চিড়িয়াখানা

দময়ন্তী : হ্যাঁ।

ব্যোমকেশ; মাফ করবেন‌, আপনার এখন বয়স কত?

দময়ন্তী : উনত্ৰিশ।

ব্যোমকেশ : বিজয়বাবু কবে থেকে আপনাদের কাছে আছেন?

বিজয় এই প্রশ্নের জবাব দিল‌, বলিল,—’আমার দশ বছর বয়সে মা-বাবা মারা যান‌, সেই থেকে আমি কাকার কাছে আছি।’

ব্যোমকেশ : আপনার এখন বয়স কত?

বিজয় : পঁচিশ।

দেবীর কাঁধের উপর আড়ষ্টভাবে শক্ত হইয়া আছে। সে যেন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে এবং প্ৰাণপণে চাপিবার চেষ্টা করিতেছে। ব্যোমকেশ নিশ্চয় তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল। কিন্তু সে নির্লিপ্তভাবে আবার প্রশ্ন করিল।

ব্যোমকেশ : বছর দুই আগে আপনি কলকাতার একটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কি নাম স্কুলটির?

দময়ন্তী : সেন্ট মাথা গার্লস স্কুল।

ব্যোমকেশ : হঠাৎ স্কুলে ভর্তি হবার কি কারণ?

দময়ন্তী : ইংরেজি শেখবার ইচ্ছে হয়েছিল।

ব্যোমকেশ : মাস আষ্টেক পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন?

দময়ন্তী : হ্যাঁ, আর ভালো লাগল না।

বরাট এতক্ষণ খাতা পেন্সিল লইয়া মাঝে মাঝে নোট করিতেছিল। ব্যোমকেশ আবার আরম্ভ করিল–

ব্যোমকেশ : পরশু রাত্রে আপনি খাওয়া সেরে রান্নাঘর থেকে কখন ফিরে এসেছিলেন?

দময়ন্তী : প্ৰায় দশটা।

ব্যোমকেশ : নিশানাথবাবু তখন কোথায় ছিলেন?

দময়ন্তী : (একটু নীরব থাকিয়া) শুয়ে পড়েছিলেন।

ব্যোমকেশ : ঘর অন্ধকার ছিল?

দময়ন্তী : হ্যাঁ।

ব্যোমকেশ : জানালা খোলা ছিল?

দময়ন্তী : বোধহয় ছিল। লক্ষ্য করিনি।

ব্যোমকেশ : সদর দরজা তখন নিশ্চয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?

দময়ন্তী : (বিলম্বে) হ্যাঁ।

ব্যোমকেশ : আপনি বাড়িতে এলেন কি করে?

দময়ন্তী; পিছনের দরজা দিয়ে।

ব্যোমকেশ; সে-রাত্রে-তারপর আপনি কি করলেন?

দময়ন্তী : শুয়ে পড়লাম।

ব্যোমকেশ; নিশানাথবাবু তখন ঘুমোচ্ছিলেন? অর্থাৎ বেঁচে ছিলেন?

দময়ন্তী : (বিলম্বে) হ্যাঁ।

ব্যোমকেশ : আপনি তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখেননি? কি করে বুঝলেন?

দময়ন্তী : নিশ্বাস পড়ছিল।

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিল, —’সুনয়না নামের কোনও মেয়েকে আপনি চেনেন?’

দময়ন্তী : না।

ব্যোমকেশ : কিছুদিন থেকে আপনার বাড়িতে কেউ মোটরের টুকরো ফেলে দিয়ে যায়—এ বিষয়ে কিছু জানেন?

দময়ন্তী : যা সকলে জানে তাই জানি।

ব্যোমকেশ : আপনার জীবনে কোনও গুপ্তকথা আছে?

দময়ন্তী : না।

ব্যোমকেশ; নিশানাথবাবুর জীবনে কোনও গুপ্তকথা ছিল?

দময়ন্তী : জানি না।

ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল,–’উপস্থিত আর কোনও প্রশ্ন নেই। বিজয়বাবু্‌, এবার ওঁকে নিয়ে যান।’

বিজয় সশব্দে একটি নিশ্বাস ফেলিল, তারপর দয়মন্তী দেবীর হাত ধরিয়া তুলিয়া পাশের ঘরে লইয়া গেল। দেখিলাম তাঁহার পা কাঁপতেছে। তাঁহার বর্তমান মানসিক অবস্থায় তীক্ষ্ণ প্রশ্নের আঘাত না করিলেই বোধহয় ভাল হইত।

ইতিমধ্যে বসিবার ঘরে জনসমাগম হইতেছিল‌, আমি দ্বারের কাছে বসিয়া দেখিতেছিলাম। প্রথমে আসিল পানুগোপাল‌, ঘরের এক কোণে গিয়া যথাসম্ভব অদৃশ্য হইয়া বসিল। তারপর আসিলেন সকন্যা নেপালবাবু; তাঁহারা সামনের চেয়ারে বসিলেন; নেপালবাবুর পোড়া মুখের দিকটা আমার দিকে রহিয়াছে তাই তাঁহার মুখভাব দেখিতে পাইলাম না‌, কিন্তু মুকুলের মুখে শঙ্কিত উদ্বেগ। সে একবার এদিক ওদিক চাহিল‌, তারপর নিম্নকণ্ঠে পিতাকে কিছু বলিল।

সর্বশেষে আসিল বনলক্ষ্মী। তাহার মুখ শুষ্ক‌, যেন চুপসিয়া গিয়াছে; রান্নার কাজ সম্ভবত তাহাকেই চালাইতে হইতেছে। তাহাকে দেখিয়া মুকুল গভীর বিতৃষ্ণাভরে ভ্রূকুটি করিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল। বনলক্ষ্মী একবার একটু দ্বিধা করিল‌, তারপর ধীরপদে খোলা জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল‌, গরাদের উপর হাত রাখিয়া বাহিরের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিল।

এদিকে বিজয় ফিরিয়া আসিয়া দময়ন্তী দেবীর পরিত্যক্ত চেয়ারে বসিয়াছিল‌, চাদরে কপালের ঘাম মুছিয়া বলিল,–’এবার আমার এজেহারও না হয় সেরে নিন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’বেশ তো। আপনাকে সামান্যই জিজ্ঞাসা করবার আছে।’

লক্ষ্য করিলাম, দময়ন্তী দেবীকে জেরা করার সময় বিজয় যতটা ততস্থ হইয়াছিল, তাহার তুলনায় এখন অনেকটা সুস্থ। কিন্তু ব্যোমকেশের প্রথম প্রশ্নেই সে থতমত খাইয়া গেল।

ব্যোমকেশ : কিছুদিন আগে নেপালবাবুর মেয়ে মুকুলের সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। আপনি প্ৰথমে রাজী ছিলেন। তারপর হঠাৎ মত বদলালেন কেন?

বিজয়; আমি-আমার-ওটা আমার ব্যক্তিগত কথা। ওর সঙ্গে কাকার মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই।

ব্যোমকেশ তাহাকে একটি নাতিদীর্ঘ নেত্রপাতে অভিষিক্ত করিয়া অন্য প্রশ্ন করিল। বলিল,–’পরশু বিকেলবেলা আপনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে রাত্রে আবার কলকাতা গিয়েছিলেন কেন?’

বিজয় : আমার দরকার ছিল।

ব্যোমকেশ : কী দরকার বলতে চান না?

বিজয় : এটাও আমার ব্যক্তিগত কথা।

ব্যোমকেশ : বিজয়বাবু্‌, আপনার ব্যক্তিগত কথা জানবার কৌতুহল আমার নেই। আপনার কাকার মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবার জন্যে আপনি আমাদের ডেকেছেন। এখন আপনিই যদি আমাদের কাছে কথা গোপন করেন তাহলে আমাদের অনুসন্ধান করে লাভ কি?

বিজয় : আমি বলছি। এর সঙ্গে কাকার মৃত্যুর কোনও সম্বন্ধ নেই।

ব্যোমকেশ : সে বিচার আমাদের হাতে ছেড়ে দিলে ভাল হয় না?

দেখিলাম বিজয়ের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছে। তারপর সে পরাভব স্বীকার করিল। অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিল,–’বেশ শুনুন। পরশু বিকেলে কলকাতা থেকে ফিরে এসে একটা চিঠি পেলাম। বেনামী চিঠি। তাতে লেখা ছিল-আপনি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। যদি বিপদে পড়তে না চান আজ রাত্রি দশটার সময় হগ সাহেবের বাজারে চায়ের দোকানে থাকবেন‌, একজনের সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারবেন। —এই চিঠি পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যে চিঠি লিখেছিল। সে এল না। এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে এলাম।’

0 Shares