ব্যোমকেশ : চিঠি আপনার কাছে আছে?
বিজয় : না, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
ব্যোমকেশ : আপনি যে পরশু রাত্রে কলকাতায় গিয়েছিলেন তার কোনও সাক্ষী আছে?
বিজয় : না, সাক্ষী রেখে যাইনি, চুপি চুপি গিয়েছিলাম।
ব্যোমকেশ : স্টেশনে গেলেন। কিসে-পায়ে হেঁটে?
বিজয়; না, কলোনীর একটা সাইকেল আছে, তাইতে।
ব্যোমকেশ : যাক। —আপনি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন, তার মানে কি?
বিজয় : জানি না।
ব্যোমকেশ : বেনামী চিঠিতে ছিল, একজনের সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারবেন। এই একজনটি কে? কারুর নাম ছিল না?
বিজয় : (ঢোক গিলিয়া) নাম ছিল না। একজনটি কে তা জানি না।
ব্যোমকেশ : তবে গেলেন কেন?
বিজয় : কে বেনামী চিঠি লিখেছে দেখবার জন্যে।
ব্যোমকেশ : ও।–কিছু মনে করবেন না, আপনি যে-দোকান দেখাশুনা করেন। তার টাকার হিসেব কি গরমিল হয়েছে?
বিজয় : (একটু উদ্ধতভাবে) হ্যাঁ হয়েছে। আমার কাকার টাকা আমার টাকা। আমি নিয়েছি।
ব্যোমকেশ : কত টাকা?
বিজয়; হিসেব করে নিইনি। দু’তিন হাজার হবে।
ব্যোমকেশ : টাকা নিয়ে কি করলেন?
বিজয়; টাকা নিয়ে মানুষ কী করে? মনে করুন রেস খেলে উড়িয়েছি।
ব্যোমকেশ তির্যক হাসিল, বলিল,–’রেস খেলে ওড়াননি। যা হোক, আর কিছু জানিবার নেই-আজত, বনলক্ষ্মীকে আসতে বল। আর যদি ভুজঙ্গধরবাবু এসে থাকেন তাঁকেও।’
ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়াছেন। কিনা দেখি নাই। আমি উঠিয়া বাহিরের ঘরে গেলাম। সকলে উচ্চকিত হইয়া চাহিল। দেখিলাম, ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়াছেন, দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন। তাহার মুখের ভাব স্বপ্নালু, আমাকে দেখিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন,–‘দন্তরুচি কৌমদী।‘
অবাক হইয়া বলিলাম,–’সে আবার কি?’
ভুজঙ্গধরবাবুর স্বপ্নালুতা কাটিয়া গেল, তিনি বলিলেন, ‘ওটা মোহমুদগরের অ্যান্টিডোট।–আমার ডাক পড়েছে? চলুন।’
‘আসুন’ বলিয়া আমি বনলক্ষ্মীর দিকে ফিরিয়াছি। এমন সময় একটা ব্যাপার ঘটিল। বনলক্ষ্মী জানালার গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ চীৎকার করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। আমি ছুটিয়া গেলাম, পাশের ঘর হইতে ব্যোমকেশ, বরাট ও বিজয় বাহির হইয়া আসিল।
বনলক্ষ্মীর কপালের ডানদিকে কাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে। ব্যোমকেশ তাহাকে তুলিতে গিয়া ঘাড় তুলিয়া চাহিল।
‘ডাক্তার, আপনি আসুন। মুর্ছা গিয়েছে।’
ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়া পরীক্ষা করিলেন। তাঁহার মুখে বিরক্তি ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন,–’সামান্য জখম, মুছা যাবার মত নয়।’
‘কিন্তু জখম হল কি করে?’
‘তা কি করে জানব? বোধহয় জানালার বাইরে থেকে কেউ ইট পাটকেল ছুড়েছিল, তাই লেগেছে।’
বরাট পকেট হইতে টর্চ লইয়া দ্রুত বাহির হইয়া গেল। ব্যোমকেশ ভুজঙ্গধরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,–’এখন একে নিয়ে কি করা যায়?’
ভুজঙ্গধরবাবু একটা মুখভঙ্গী করিলেন, তারপর বনলক্ষ্মীকে দুই বাহুর দ্বারা তুলিয়া লইয়া বলিলেন,–’আমি ওকে ওর কুঠিতে নিয়ে যাচ্ছি, বিছানায় শুইয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিলেই জ্ঞান হবে। যেখানটা কেটে গেছে সেখানে টিঞ্চার আয়োডিন দিয়ে বেঁধে দিলেই চলবে। আপনারা কাজ চালান, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
বিজয় এতক্ষণ যেন মোহাচ্ছন্ন হইয়া ছিল, বলিল—’চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।’
‘আসুন বলিয়া ভুজঙ্গধরবাবু বনলক্ষ্মীকে লইয়া অগ্রসর হইলেন। দ্বার দিয়া বাহির হইতে হইতে তিনি বিজয়কে বলিতেছেন শুনিতে পাইলাম—’আপনি বরং এক কাজ করুন, আমার কুঠি থেকে টিঙ্কার আয়োডিনের শিশি আর ব্যাণ্ডেজ নিয়ে আসুন—‘
ব্যোমকেশ আর পাশের ঘরে ফিরিয়া না গিয়া এই ঘরেই বসিল, বলিল,–’কি বিপত্তি! অজিত, তুমি তো উপস্থিত ছিলে, কি হয়েছিল বল দেখি?’
যাহা যাহা ঘটিয়াছিল বলিলাম, দন্তরূচি কৌমুদীও বাদ দিলাম না। শুনিয়া ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল।
বরাট ফিরিয়া আসিয়া বলিল,–’কাউকে দেখতে পেলাম না। জানালার বাইরে মানুষের পায়ের দাগ রয়েছে কিন্তু কাঁচা দাগ বলে মনে হল না। ইট পাটকেল অবশ্য অনেক পড়ে রয়েছে।’
যেখানে বনলক্ষ্মী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়ছিল। সেখানে একটা বাঁকা কালো জিনিস আলোয় চিকমিক করিতেছিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া সেটা তুলিয়া লইল, আলোয় ধরিয়া বলিল,–’ভাঙা কাচের চুড়ি। বোধহয় বনলক্ষ্মী পড়ে যাবার সময় চুড়ি ভেঙেছে।’
চুড়ির টুকরো বরাটকে দিয়া ব্যোমকেশ আবার আসিয়া বসিল, নেপালবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,–’আপনারা বোধহয় জানেন, পুলিসের সন্দেহ নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাই একটু খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে।–নেপালবাবু্, যে-রাত্ৰে নিশানাথবাবু মারা যান সে-রত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’
সোজাসুজি প্রশ্ন, প্রশ্নের অন্তর্নিহিত সন্দেহটিও খুব অস্পষ্ট নয়। নেপালবাবুর গলার শির উঁচু হইয়া উঠিল, কিন্তু তিনি বরাটের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করিয়া কষ্ট-সংযত কণ্ঠে বলিলেন,–’দাবা
খেলছিলাম।’
এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপালের উপর চোখ পড়িল। সে কানের তুলা খুলিয়া ফেলিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া একাগ্রভাবে শুনিবার চেষ্টা করিতেছে।
ব্যোমকেশ : দাবা খেলছিলেন? কার সঙ্গে?
নেপাল : মুকুলের সঙ্গে।
ব্যোমকেশ; উনি দাবা খেলতে জানেন?
নেপাল; জানে কিনা একবার খেলে দেখুন না!
ব্যোমকেশ; না না, তার দরকার নেই। তা আপনারা যখন খেলছিলেন, সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল?
নেপাল : কেউ না। নিশানাথ যে সেই সময় মারা যাবে তা জানতাম না, জানলে সাক্ষী যোগাড় করে রাখতাম।
ব্যোমকেশ; সে-রত্রে আপনারা এদিকে আসেননি?