চিড়িয়াখানা

নেপাল : এদিকে আসব কি জন্যে? গরমে রাত্রে ঘুম আসে না। তাই দাবা খেলছিলাম।

ব্যোমকেশ : তাহলে-সো-রাত্রে এ বাড়িতে কেউ এসেছিল। কিনা তা আপনারা বলতে পারেন

নেপাল : না।

এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপাল হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে‌, চোখ দুটা জ্বলজ্বল করিতেছে। সে প্ৰাণপণে একটা কিছু বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু মুখ দিয়া শব্দ বাহির হইল না। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’আপনি কি কিছু বলবেন? পানু সবেগে ঘাড় নাড়িয়া আবার কথা বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু এবারও কৃতকাৰ্য হইল না।

নেপালবাবু মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন,–’যত সব হাবা কালার কাণ্ড।’

দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম ভুজঙ্গধরবাবু ফিরিয়া আসিয়াছেন এবং তীক্ষ্ণচক্ষে পানুগোপালকে দেখিতেছেন। তিনি অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন,–’পানু। বোধহয় কিছু বলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ও এখন উত্তেজিত হয়েছে‌, কিছু বলতে পারবে না। পরে ঠাণ্ডা হলে হয়তো—‘

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’ওদিকের খবর কি?’

‘বনলক্ষ্মীর জ্ঞান হয়েছে। কপাল ড্রেস করে দিয়েছি।’

‘বিজয়বাবু কোথায়?’

‘তিনি বনলক্ষ্মীর কাছে আছেন।’ ভুজঙ্গধরবাবুর অধরপ্রান্ত একটু প্রসারিত হইল।

নেপালবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, কর্কশাস্বরে বলিলেন,–’আপনাদের জেরা আশা করি শেষ হয়েছে। আমরা এবার যেতে পারি?’

ব্যোমকেশ : একটু দাঁড়ান। (মুকুলকে) আপনি কখনও সিনেমায় অভিনয় করেছেন?

মুকুলের মুখ শুকাইয়া গেল‌, সে ত্ৰস্ত-চোখে চারিদিকে চাহিয়া স্মৃলিতস্বরে বলিল,–’আমি–না‌, আমি কখনও সিনেমায় অভিনয় করিনি।’

নেপালবাবু। গর্জন করিয়া উঠিলেন,–’মিথ্যে কথা! কে বলে আমার মেয়ে সিনেমা করে! যত সব মিথ্যুক ছোটলোকের দল।’

ব্যোমকেশ শাস্তস্বরে বলিল,–’আপনার মেয়েকে সিনেমা স্টুডিওতে যাতায়াত করতে দেখেছে এমন সাক্ষীর অভাব নেই।‘

নেপাল আবার গর্জন ছাড়িতে উদ্যত হইয়াছিলেন‌, মুকুল পিতাকে থামাইয়া দিয়া বলিল,–’সিনেমা স্টুডিওতে আমি কয়েকবার গিয়েছি সত্যি, কিন্তু অভিনয় করিনি। চল বাবা।’ বলিয়া মুকুল ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। নেপালবাবু বাঘের মত এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে তাহার পশ্চাদ্বর্তী হইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,–’রমেনবাবু ঠিকই ধরেছিলেন। যাক‌, ভূজঙ্গধরবাবু্‌, আপনাকেও একটি মাত্র প্রশ্ন করব। সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’

ভুজঙ্গধরবাবু একপেশে হাসি হাসিয়া বলিলেন,–’সে-রত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে বসে অনেকক্ষণ সেতার বাজিয়েছিলাম। সাক্ষী সাবুদ আছে কিনা জানি না।‘

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল, তারপর উঠিয়া বরাটকে বলিল,–‘চলুন বনলক্ষ্মীকে দেখে আসি।’

১৬

বরাট‌, ব্যোমকেশ ও আমি বনলক্ষ্মীর কুঠিতে উপস্থিত হইলাম। ভিতরে প্রবেশ করিবার সময় পাশের খোলা জানালা দিয়া একটি নিভৃত দৃশ্য চোখে পড়িল। ঘরটি বোধহয় বনলক্ষ্মীর শয়নঘর; আলো জ্বলিতেছিল‌, কনলক্ষ্মী শয্যায় শুইয়া আছে‌, আর বিজয় শয্যার পাশে বসিয়া মৃদুস্বরে তাহার সহিত বাক্যালাপ করিতেছে।

আমাদের পদশব্দে বিজয় বাহির হইয়া আসিল। বলিল, —’বনলক্ষ্মী এখনও বড় দুর্বল। মাথার চোট গুরুতর নয়‌, কিন্তু স্নায়ুতে শক লেগেছে। তাকে এখন জেরা করা ঠিক হবে কি?’

ব্যোমকেশ স্নিগ্ধস্বরে বলিল,–’জেরা করব না‌, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা শুধু তাকে দেখতে এসেছি‌, দেখেই চলে যাব।’

‘তা—আসুন।’

ব্যোমকেশ ঘনিষ্ঠভাবে বিজয়ের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল,–’আপনাকে কিন্তু আর একটি কাজ করতে হবে বিজয়বাবু। একাজ আপনি ছাড়া আর কারুর দ্বারা হবে না।’

‘কি করতে হবে বলুন।’

‘পানুগোপাল কিছু জানে‌, আপনার কাকার মৃত্যুর রাত্রে বোধহয় কিছু দেখেছিল।! কিন্তু সে উত্তেজিত হয়েছে‌, কিছু বলতে পারছে না। আপনি তাকে ঠাণ্ডা করে কথাটা বার করে নিতে পারেন? আমরা পারব না‌, আমাদের দেখলেই সে আবার উত্তেজিত হয়ে উঠবে।’

বিজয় উৎসুক হইয়া বলিল, —’আচ্ছা‌, দেখি চেষ্টা করে।’ বলিয়া সে চলিয়া গেল।

আমরা বনলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিলাম।

লোহার সরু খাটের উপর বিছানা। বনলক্ষ্মী খাটের ধারে উঠিয়া বসিয়াছে‌, তাহার কপালে পটি বাঁধা। আমাদের দেখিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিল।

ব্যোমকেশ বলিল,–’উঠবেন না‌, উঠবেন না‌, আপনি শুয়ে থাকুন।’

বনলক্ষ্মী লজ্জিতমুখে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল,–’কোথায় যে বসতে দেব আপনাদের!’

ব্যোমকেশ বলিল,–’সে ভাবনা ভাবতে হবে না। আপনাকে। আপনি শুয়ে পড়ুন তো আগে।’

বনলক্ষ্মী গুটিসুটি হইয়া শুইল। ব্যোমকেশ তখন খাটের পাশে বসিল‌, আমরা দু’জনে খাটের পায়ের কাছে দাঁড়াইলাম। ক্ষুদ্র নিরাভরণ ঘর; লোহার খাটটি ছাড়া বলিতে গেলে আর কিছুই নাই।

ব্যোমকেশ হাল্কা গল্প করার ভঙ্গীতে বলিল,–’কী হয়েছিল বলুন দেখি? বাইরে থেকে কেউ ঢিল ছুঁড়েছিল?’

বনলক্ষ্মী দুর্বল কণ্ঠে বলিল,–’কিছু জানি না। জানালার গরদ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলুম‌, তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হল ডাক্তারবাবুর টিঞ্চার আয়োডিনের জ্বলুনিতে।’

‘কপালে ছাড়া আর কোথাও লেগেছে নাকি?’

বনলক্ষ্মী ডান হাত তুলিয়া দেখাইল,–’হাতে কাচের চুড়ি ছিল‌, ভেঙে গেছে। হাতে একটু আঁচড় লেগেছে। বোধহয় হাতটা মাথার কাছে ছিল‌, একসঙ্গে লেগেছে-?

‘তা হতে পারে।’ ব্যোমকেশ হাত পরীক্ষা করিয়া বলিল,–’প্রথমে বোধহয় ইট আপনার হাতে লেগেছিল‌, তাই মাথায় বেশি চোট লাগেনি। আচ্ছা‌, কে ইট ছুড়তে পারে? কিলোনীতে এমন কেউ আছে কি‌, যে আপনার প্রতি প্ৰসন্ন নয়?’

0 Shares