‘কাল সকালে। তবে এবার ভগ্নাংশ নয়, একটি আস্ত ছেলেখেলার মোটর।’
‘বাঃ! লোকটি সত্যিই রসিক মনে হচ্ছে। এ ব্যাপার অবশ্য কলোনীর সবাই জানে?’
‘জানে। এটা একটা হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘আচ্ছা, আপনার মোটর আছে?’
‘না। আমাদের কোথাও যাতায়াত নেই, মেলামেশা নেই,–সামাজিক জীবন কলোনীর মধ্যেই আবদ্ধ। তাই ইচ্ছে করেই মোটর রাখিনি।’
‘কলোনীতে এমন কেউ আছে যার কোনকালে মোটরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল?’
নিশানাথবাবুর অধরপ্রান্ত সম্মিত ব্যঙ্গভরে একটু প্রসারিত হইল,–’আমাদের কোচম্যান মুস্কিল চিত্র আগে মোটর ড্রাইভার ছিল, বারবার স্নাশ ড্রাইভিং-এর জন্য তার লাইসেন্স কেড়ে নিয়েছে।’
‘কি নাম বললেন, মুস্কিল মিঞা?’
‘তার নাম নূরুদ্দিন কিম্বা ঐ রকম কিছু। সকলে ওকে মুস্কিল মিঞা বলে! মুস্কিল শব্দটা ওর কথার মাত্রা।’
‘ও–আর কেউ?’
‘আর আমার ভাইপো বিজয়ের একটা মোটর-বাইক ছিল, কখনও চলত, কখনও চলত না। গত বছর বিজয় সেটা বিক্রি করে দিয়েছে।’
‘আপনার ভাইপো। তিনিও কলোনীতে থাকেন?’
‘হ্যাঁ। মূনিসিপাল মার্কেটের ফুলের স্টল সেই দেখে। আমার ছেলেপুলে নেই, বিজয়কেই আমার স্ত্রী পনরো বছর বয়স থেকে নিজের ছেলের মত মানুষ করেছেন।’
ব্যোমকেশ আবার ফ্যানের দিকে চোখ তুলিয়া বসিয়া রহিল। তারপর বলিল,–’মিস্টার সেন, আপনার জীবনে কখনও-দশ বছর আগে হোক বিশ বছর আগে হোক-এমন কোনও লোকের সংস্পর্শে এসেছিলেন কি যার মোটর ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক আছে? ধরুন, মোটরের দালাল কিম্বা ঐরকম কিছু? মোটর মেকানিক-?’
এবার নিশানাথবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর যখন কথা কহিলেন তখন তাঁহার কণ্ঠস্বর আরও চাপা শুনাইল। বলিলেন,–’বারো বছর আগে আমি যখন সেশন জজ ছিলাম, তখন লাল সিং নামে একজন পাঞ্জাবী খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আমার এজলাসে এসেছিল। তার একটা ছোট মোটর মেরামতের কারখানা ছিল।’
‘তারপর?’
‘লাল সিং ভয়ানক ঝগড়াটে বদরাগী লোক ছিল, তার কারখানার একটা মিস্ক্রিকে মোটরের স্প্যানার দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছিল। বিচারে আমি তাকে ফাঁসির হুকুম দিই।’ একটু হাসিয়া বলিলেন,–’হুকুম শুনে লাল সিং আমাকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল হল। আপীলে আমার রায় বহাল রইল বটে, কিন্তু ফাঁসি মকুব হয়ে চৌদ্দ বছর জেল হল।’
‘চৌদ্দ বছর জেল! তার মানে লাল সিং এখনও জেলে আছে।’
নিশানাথবাবু বলিলেন,–’জেলের কয়েদীরা শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলে তাদের মেয়াদ কিছু মাফ হয়। লাল সিং হয়তো বেরিয়েছে।’
‘খোঁজ নিয়েছেন? জেল-বিভাগের দপ্তরে খোঁজ নিলেই জানা যেতে পারে।’
‘আমি খোঁজ নিইনি।’
নিশানাথবাবু উঠিলেন। বলিলেন,–’আর আপনাদের সময় নষ্ট করব না, আজ উঠি। আমার যা বলবার ছিল সবই বলেছি। দেখবেন যদি কিছু হদিস পান। কে এমন অনর্থক উৎপাত করছে জানা দরকার।’
ব্যোমকেশও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,–’অনৰ্থক উৎপাত নাও হতে পারে।’
নিশানাথ বলিলেন,–’তাহলে উৎপাতের অর্থ কি সেটা আরও বেশি জানা দরকার।’ প্যান্টুলুনের পকেট হইতে এক গোছা নোট লইয়া কয়েকটা গণিয়া টেবিলের উপর রাখিলেন,–’আপনার পারিশ্রমিক পঞ্চাশ টাকা আগাম দিয়ে গেলাম। যদি আরও লাগে পরে দেব।–আচ্ছা।’
নিশানাথবাবু দ্বারের দিকে চলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’ধন্যবাদ।’
দ্বার পর্যন্ত গিয়া নিশানাথবাবু দ্বিধাভরে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন,–’আর একটা কথা মনে পড়ল। সামান্য কাজ, ভাবছি সে কাজ আপনাকে করতে বলা উচিত হবে কিনা।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’বলুন না।’
নিশানাথ কয়েক পা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন,–’একটি স্ত্রীলোকের সন্ধান করতে হবে। সিনেমার অভিনেত্রী ছিল, নাম সুনয়না। বছর দুই আগে কয়েকটা বাজে ছবিতে ছোট পার্ট করেছিল, তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। যদি তার সন্ধান পান ভালই, নচেৎ তার সম্বন্ধে যত কিছু খবর সংগ্ৰহ করা যায় সংগ্ৰহ করতে হবে। আর যদি সম্ভব হয়, তার একটা ফটোগ্রাফ যোগাড় করতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’যখন সিনেমার অভিনেত্রী ছিল তখন ফটো যোগাড় করা শক্ত হবে না। দু’এক দিনের মধ্যেই আমি আপনাকে খবর দেব।’
‘ধন্যবাদ।’ নিশানাথবাবু প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ প্রথমেই পাঞ্জাবিটা খুলিয়া ফেলিল, তারপর নোটগুলি টেবিল হইতে তুলিয়া গণিয়া দেখিল। তাহার মুখে সকৌতুক হাসি ফুটিয়া উঠিল। নোটগুলি দেরাজের মধ্যে রাখিতে রাখিতে সে বলিল–’নিশানাথবাবু কেতাদুরস্ত সিভিলিয়ান হতে পারেন। কিন্তু তিনি বিষয়ী লোক নন।’
আমি উড়ানির খোলস ছাড়িয়া দাবার ঘুঁটিগুলি কৌটোয় তুলিয়া রাখিতেছিলাম, প্রশ্ন করিলাম,–’কোন?’
সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ তক্তপোশে আসিয়া বসিল, বলিল–’পঞ্চাশ টাকা দিলাম বলে ষাট টাকার নোট রেখে গেছেন। লোকটি বুদ্ধিমান, কিন্তু টাকাকড়ি সম্বন্ধে ঢ়িলে প্রকৃতির।’
আমি বলিলাম,–’আচ্ছা ব্যোমকেশ, উনি যে সিভিলিয়ান ছিলেন, তুমি এত সহজে বুঝলে কি করে?’
সে বলিল,–’বোঝা সহজ বলেই সহজে বুঝলাম। উনি যে-বেশে এসেছিলেন, সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোক ও-বেশে বেড়ায় না, নিজের পরিচয় দেবার জন্য কার্ডও বের করে না। ওটা বিশেষ ধরনের শিক্ষাদীক্ষার লক্ষণ।। ওঁর কথা বলার ভঙ্গীতেও একটা হাকিমী মন্থরতা আছে।–কিন্তু ও কিছু নয়, আসল কথা হচ্ছে উনি কি জন্যে আমার কাছে এসেছিলেন।’
‘তার মানে?’ ‘উনি দুটো সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন; এক হচ্ছে মোটরের ভগ্নাংশ লাভ; আর দ্বিতীয়, চিত্রাভিনেত্রী সুনয়না।–কোনটা প্রধান?’