চিড়িয়াখানা

বনলক্ষ্মী ব্যথিত স্বরে বলিল,–’মুকুল আর নেপালবাবু আমাকে-পছন্দ করেন না। তা ছাড়া-তা ছাড়া–’

‘তা ছাড়া ভুজঙ্গধরবাবুও আপনার ওপর সন্তুষ্ট নন।’

বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ বলিল,–’ভুজঙ্গধরবাবু হয়তো আপনাকে দেখতে পারেন না‌, কিন্তু সেজন্য ওঁর কর্তব্যে ত্রুটি হয় না। ‘

বনলক্ষ্মীর অধরে একটু তিক্ত হাসি ফুটিয়া উঠিল‌, সে বলিল,–’না‌, তা হয় না। আমার কপালে খুব টিঙ্কার আয়োডিন ঢেলেছেন।’

ব্যোমকেশ হাসিল,–’যাক।–ব্ৰজদাস বাবাজী আর রসিকবাবুর সঙ্গে আপনার কোনও রকম অসদ্ভাব–?’

বনলক্ষ্মী বলিল,–’ব্ৰিজদাস ঠাকুর খুব ভাল লোক ছিলেন‌, আমাকে স্নেহ করতেন। কেন যে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন–’

‘আর রসিকবাবু?’

‘রসিকবাবুকে আমি দেখেছি‌, এই পর্যন্ত। কখনও কথা হয়নি।–তিনি মিশুকে লোক ছিলেন না‌, নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন।’

‘ওকথা যাক। আপনি এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন তো?’

বনলক্ষ্মী একটু হাসিল,–’হ্যাঁ।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’তাহলে বাঁধা বুলিটা আউড়ে নিই। সে-রত্রে দশটা এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’

বনলক্ষ্মীর চোখে অন্ধকার জমিয়া উঠিল। অতি অস্ফুট স্বরে সে বলিল,–’কাকাবাবুর মৃত্যু তাহলে–?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’তাই মনে হচ্ছে।’ বনলক্ষ্মী ক্ষণকাল চোখ বুজিয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’সো-রাত্রে রান্নাঘর থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে আসার পর আমি অনেকক্ষণ কলে সেলাই করেছিলুম।’

বাহিরের ঘরে একটি পায়ে-চালানো সেলাইয়ের মেশিন দেখিয়াছি; পূর্বে নিশানাথবাবু বনলক্ষ্মীকে দর্জিখানার পরিচারিকা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন মনে পড়িল।

ব্যোমকেশ নরম সুরে বলিল,–’আপনি তো কলোনীর সকলের জামা-কাপড় সেলাই করেন। অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল বুঝি?’

‘না‌, কাজ বেশি জমা হয়নি। কাকাবাবুর জন্যে সিল্কের একটা ড্রেসিং গাউন তৈরি করছিলুম।’ বনলক্ষ্মীর চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া উঠিল।

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,–’আচ্ছা বলুন দেখি‌, আপনি সে-রাত্রে যখন সেলাইয়ের কল চালাচ্ছিলেন‌, তখন ভুজঙ্গধরবাবুকে সেতার বাজাতে শুনেছিলেন? ওঁর কুঠি তো আপনার পাশেই?’

বনলক্ষ্মী চোখ মুছিয়া মাথা নাড়িল,–’না‌, আমি কিছু শুনিনি। কনের কাছে কল চলছিল, শুনব কি করে? তাহার যেন একটু রাগ-রাগ ভাব।

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল,–’শুধু যে ভুজঙ্গধরবাবু আপনাকে দেখতে পারেন না তা নয়‌, আপনিও তাঁকে দেখতে পারেন না। ভুজঙ্গধরবাবু সে-রত্রে নিজের ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছিলেন‌, অন্তত তাই বললেন। আপনি যদি না শুনে থাকেন‌, তাহলে বলতে হবে উনি মিথ্যে কথা বলেছেন।’

এবার বনলক্ষ্মীর মুখের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইল। লজ্জা ও অনুতাপভরা মুখে সে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া আবেগভরা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল,–’না! উনি সেতার বাজাচ্ছিলেন। আমি কল চালাবার ফাঁকে ফাঁকে শুনেছিলাম!’

বোমকেশ তাহার হাতটি দুই হাতের মধ্যে লইয়া বলিল—তবে যে আগে বললেন শোনেননি!’

বনলক্ষ্মীর অধর স্ফুরিত হইল‌, অনুতাপের সহিত অভিমান মিশ্রিত হইল। সে বলিল,–’উনি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যাভার করেন–’

‘কিন্তু কোন ও রকম ব্যবহার করেন? কোনও কারণ আছে কি?’

বনলক্ষ্মী হাত ছাড়াইয়া লইয়া একবার কপালের উপর আঙ্গুল বুলাইয়া অর্ধস্মৃটি স্বরে বলিল,–’সে আপনার শুনে কাজ নেই।’

‘কিন্তু আমার যে জানা দরকার।’

বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ আবার অনুরোধ করিল। তখন বনলক্ষ্মী লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল–

‘আমার কথা বোধহয় শুনেছেন‌, নিজের দোষে ইহকাল পরকাল নষ্ট করেছি। কাকাবাবু আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাই-নইলে—‘

‘আমি এখানে আশ্রয় পাবার পর ডাক্তারবাবু আমার সঙ্গে খুব সদয় ব্যাভার করেছিলেন। উনি খুব মিশুকে‌, ওঁকে আমার খুব ভাল লাগত। উনি চমৎকার সেতার বাজাতে পারেন। আমার ছেলেবেলা থেকে গান-বাজনার দিকে ঝোঁক‌, কিন্তু কিছু শিখতে পারিনি। একদিন ওঁর কাছে গিয়ে বললুম‌, আমি সেতার শিখব‌, আমাকে শেখাবেন?—’

‘তারপর?’

বনলক্ষ্মীর চোখ ঝাপসা হইয়া গেল,–’উনি যে প্রস্তাব করলেন তাতে ছুটে পালিয়ে এলুমি…আমি জীবনে একবার ভুল করেছি। তাই উনি মনে করেন। আমি–’ তাহার স্বর বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,–’ভুজঙ্গবাবু তো খাসা মানুষ। একথা কেউ জানে?’

বনলক্ষ্মী জিভ কাটিল,–’আমি কাউকে কিছু বলিনি। একথা কি বলবার? বললে কেউ বিশ্বাস করত না…যে-মেয়ের একবার বদনাম হয়েছে—‘

বাহিরে পায়ের শব্দ হইল। বনলক্ষ্মী চমকিয়া ত্ৰস্তস্বরে ফিস ফিস্ করিয়া বলিল, —’উনি-বিজয়বাবু আসছেন! ওঁকে যেন কিছু বলবেন না। উনি রাগী মানুষ—’

‘ভয় নেই’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

দ্বারের কাছে বিজয়ের সঙ্গে দেখা হইল। ব্যোমকেশ বলিল, —’কি হল? পানুগোপালের কাছ থেকে কিছু বার করতে পারলেন?’

বিজয় বিষন্ন বিরক্তির সহিত বলিল,–’কিছু না। পানুটা ইডিয়ট; হয়তো ওর কিছুই বলবার নেই‌, যখন বলতে পারবে তখন দেখা যাবে অতি তুচ্ছ কথা। আপনাদের কোনই কাজে লাগবে না।‘

‘তা হতে পারে। তবু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি নেই। কাজের কথাও বেরিয়ে পড়তে পারে।’

‘কাল সকালে আর একবার চেষ্টা করে দেখব।’

‘আচ্ছা। আজ চলি তাহলে।’

‘আসুন। দরকার হলে কাল টেলিফোন করব।’

বিজয় রহিয়া গেল‌, আমরা বাহিরে আসিলাম। কুঠি হইতে নামিবার স্থানটি অন্ধকার। বরাট টর্চ জ্বলিল।

0 Shares