পাশের যে জানোলা দিয়া বনলক্ষ্মীর শয়নঘর দেখা যায়, তাহার নীচে একটা কালো কাপড়-ঢাকা মূর্তি লুকাইয়া ছিল, টর্চের প্রভা সেদিকে পড়িতেই প্ৰেত-মূর্তির মত একটা ছায়া সন্ট্র করিয়া সরিয়া গেল, তারপর গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হইল। ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে বরাটের হাত হইতে টর্চ কাড়িয়া লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। আমরা বোকার মত ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলাম, তারপর অন্ধকারে হোঁচট খাইতে খাইতে তাহার অনুসরণ করিলাম।
কিছুদূর যাইবার পর দেখা গেল ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিতেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিল,–’ধরতে পারলাম না। নেপালবাবুর কুঠির পিছন পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ মিলিয়ে গেল।’
বরাট বলিল,–’লোকটা কে আন্দাজ করতে পারলেন?’
‘উঁহু। তবে মেয়েমানুষ। দৌড়বার সময় মনে হল বাতাসে গোলাপী আতরের গন্ধ পেলাম। একবার চুড়ি কিম্বা চাবির আওয়াজও যেন কানে এল।’
‘মেয়েমানুষ-কে হতে পারে?’
‘মুকুল হতে পারে, মুস্কিলের বিবি হতে পারে, আবার দময়ন্তী দেবীও হতে পারেন। —চলুন, সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।’
বরাট স্টেশন পর্যন্ত আমাদের পৌছাইয়া দিতে আসিল-ট্রেন তখনও আসে নাই। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনাকে আর একটা কাজ করতে হবে। ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি মনে করবেন না। আমি আপনার ওপর সদরি করছি। এ কাজে আমরা সহযোগী। আপনার পেছনে পুলিসের অফুরন্ত এক্তিয়ার রয়েছে, আপনি যে-কাজটা পাঁচ মিনিটে করতে পারবেন। আমি করতে গেলে সেটা পাঁচ দিন লাগবে। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি–’
বরাট হাসিয়া বলিল,–’কি কাজ করতে হবে বলুন না।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’গুপ্তচর লাগাতে হবে। কলোনী থেকে কে কখন কলকাতায় যাচ্ছে তার খবর আমার দরকার। যেই খবর পাবেন সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টেলিফোন করবেন।’
‘তাই হবে। কলোনীতে আর স্টেশনে লোক রাখব। —বনলক্ষ্মীর ভাঙা চুড়িটা আমায় দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে কী করা যাবে?’
‘ওটা ফেলে দিতে পারেন। ভেবেছিলাম পরীক্ষা করাতে হবে, কিন্তু তার দরকার নেই।’
‘আর কিছু?
আপাতত আর কিছু নয়। —আজ যা দেখলেন শুনলেন তা থেকে কি মনে হল? কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?’
‘দময়ন্তীকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হচ্ছে।’
‘কিন্তু এ স্ত্রীলোকের কাজ নয়।’
‘স্ত্রীলোকের সহকারী থাকতে পারে তো।’
ব্যোমকেশ চকিতে বরাটের পানে চোখ তুলিল।
‘সহকারী কে হতে পারে?’
‘সেটা বলা শক্ত। যে-কেউ হতে পারে। বিজয় হতে বাধা কি? ও যেভাবে কাকীমাকে আগলে বেড়াচ্ছে দেখলাম
‘হ্যাঁ–ভাববার কথা বটে। ওদিকে নেপালবাবুর সঙ্গেও দময়ন্তী দেবীর একটা প্রচ্ছন্ন সংযোগ রয়েছে।‘
‘আচ্ছা, দময়ন্তীর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে কিছু জানা গেছে?
‘দুর্নাম কিছু শুনিনি, বরং ভালই শুনেছি।’
‘আপনার গাড়ি এসে পড়েছে। হ্যাঁ, রসিক দে’র সবজি-দোকানের হিসেব-পত্ৰ দেখবার ব্যবস্থা করেছি। যদি সত্যিই চুরি করে থাকে, ওর নামে ওয়ারেন্ট বের করব।’
ট্রেনের শূন্য কামরায় ব্যোমকেশ একটা বেঞ্চিতে চিৎ হইয়া আলোর দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ স্বপ্নাচ্ছিন্ন হইয়া রহিল। তারপর হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল,–’চিড়িয়াখানাই বটে।’
উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম,–’হঠাৎ একথা কেন?’
ব্যোমকেশ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল,–’চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কি? নাম-কাটা ডাক্তার সংস্কৃত শ্লোক আওড়ায়, মুখপোড়া প্রফেসর রাত দুপুরে মেয়ের সঙ্গে দাবা খেলে, কর্তাকে দোর-বন্ধ বাড়িতে ঢুকে কেউ খুন করে যায়। কিন্তু পাশের ঘরে গৃহিণী কিছু জানতে পারেন না, কর্তার ভাইপো খুড়োর তহবিল ভেঙ্গে সগর্বে সেকথা প্রচার করে, বোষ্টম ফেরারী হয়, গাড়োয়ানের বৌ আড়ি পাতে–। চিড়িয়াখানা আর কাকে বলে?’
জিজ্ঞাসা করিলাম,—’আজকের অনুসন্ধানে কিছু পেলে?’
‘এইটুকু পেলাম যে সবাই মিথ্যে কথা বলছে। নির্জলা মিথ্যে বলছে না। সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে এমনভাবে বলছে যে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে ধরা যায় না।’
‘বনলক্ষ্মীও মিথ্যে বলছে?’
‘অন্তত বলবার তালে ছিল। নেহাৎ বিবেকের দংশনে সত্যি কথা বলে ফেলল।’
‘আচ্ছা, অ্যালিবাই সম্বন্ধে কি মনে হল?’
‘কারুর অ্যালিবাই পাকা নয়। বিজয় বলছে, ঠিক যে-সময় খুন হয় সে-সময় সে কলকাতায় ছিল, অথচ তার কোনোও সাক্ষী-প্রমাণ নেই, বেনামী চিঠিখানা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নেপালবাবু মেয়ের সঙ্গে দাবা খেলছিলেন, কেউ তাঁদের খেলতে দেখেনি। ডাক্তার অন্ধকারে সেতার বাজাচ্ছিলেন, একজন কানে শুনেছে কিন্তু চোখে দেখেনি। বনলক্ষ্মী কলে সেলাই করছিল, সাক্ষী নেই। দময়ন্তীর কথা ছেড়েই দাও। এর নাম কি অ্যালিবাই?’
ব্যোমকেশ খানিকক্ষণ বাহিরের অপসৃয়মান আলো-আঁধারের পানে চাহিয়া রহিল, তাহার ললাটে চিন্তার ভ্রূকুটি। সে বলিল,–’বনলক্ষ্মী একবার আমার হাত ধরেছিল, লক্ষ্য করেছিলে?’
বলিলাম,–’লক্ষ্য আবার করিনি! তুমিও দুহাতে তার হাত ধরে কত আদর করলে দেখলাম।’
ব্যোমকেশ ফিক হাসিল,–’আদর করিনি, সহানুভূতি জানাচ্ছিলাম।–কিন্তু আশ্চর্য বনলক্ষ্মীর বাঁ হাতের তর্জনীর ডগায় কড়া পড়েছে।’
বলিলাম,–’এ আর আশ্চর্য কি? যারা সেলাই করে তাদের আঙুলে কড়া পড়েই থাকে।’
ব্যোমকেশ চিন্তাক্রান্ত মুখে সিগারেটে একটা সুখ-টান দিয়া সেটা বাহিরে ফেলিয়া দিল। তারপর আবার লম্বা হইয়া শুইল।
সে-রাত্রে বাসায় ফিরিতে সাড়ে এগারোটা বাজিল। আর কোনও কথা হইল না, তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া শুইয়া পড়িলাম।
১৭