চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’সহকর্মী কিম্বা সহকর্মিণী। একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে যে কাজ অসম্ভব‌, দু’জন স্ত্রীলোক মিলে সে কাজ সহজেই করতে পারে। কিন্তু আসল কথা নিকোটিন। এ বিষ এল কোত্থেকে? ইন্সপেক্টর বরাট‌, আপনি নিকোটিন সম্বন্ধে কিছু জানেন?

বরাট বলিল,–’ওটা ভয়ঙ্কর বিষ এই জানি। আপনার মুখে সুনয়নার কথা শোনবার পর খোঁজখবর নিয়েছিলাম‌, দেখলাম ওষুধের দোকানে ও-মাল পাওয়া যায় না; কোথাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। এক যদি কোনও বড় ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় তো বলতে পারি না।’

‘এক হতে পারে যে-ব্যক্তি বিষ ব্যবহার করেছে সে নিজে একজন কেমিস্ট কিংবা কোনও কেমিস্টকে দিয়ে বিষ তৈরি করিয়েছে।’

‘তা হতে পারে। কেমিস্ট তো একজন হাতের কাছেই রয়েছে।–নেপাল গুপ্ত।’

‘যদি নেপাল গুপ্ত হয়‌, সুনয়নার সঙ্গে তার সম্বন্ধ কি?’

‘বাপ-বেটি হতে বাধা কি?’

আমি বলিলাম,–’নেপালবাবুর সঙ্গে দময়ন্তী দেবীরও যোগাযোগ আছে—তাঁরা দু’জনে হতে পারেন।’

ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল,–’দিময়ন্তী দেবী আর বিজয় হতে পারে‌, বিজয় আর বনলক্ষ্মী

ব্ৰজদাস হতে পারে‌, এমন কি মুস্কিল মিঞা আর নজর বিবি হতে পারে। সম্ভাবনা অনেকগুলো রয়েছে‌, কিন্তু কেবল সম্ভাবনার কথা গবেষণা করে কোনও লাভ হবে না। পাকাপাকি জানতে হবে।’

বরাট জলযোগ শেষ করিয়া মুখ মুছিতে মুছিতে বলিল, —’বেশ তো‌, পাকাপাকি জানার একটা উপায় বলুন না। পুলিসের দিক থেকে আর কোনও বাধা নেই‌, পানুকে যে খুন করা হয়েছে—আমার কর্তারা তা স্বীকার করবেন; সুতরাং পুলিসের যা-কিছু কর্তব্য সবই আমি করতে পারি। এখন কি করতে হবে বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল,–‘এক, কলোনীর সকলের কুঠি খানাতল্লাস করে দেখতে পারেন, কিন্তু নিকোটিন পাবেন না। আমার মনে হয়‌, রুটিন-মাফিক কাজে কোনও ফল হবে না। বরং আপাতত কিছুদিন বসে থাকা ভাল।’

‘চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকব?’

‘একেবারে হাত গুটোবার দরকার নেই। ব্ৰজদাস আর রসিকের তল্লাস যেমন চলছে চলুক। রসিকের দোকানের খাতপত্র পরীক্ষা করুন। আর কলোনীতে গুপ্তচর বসান। কে কখন বাইরে যাচ্ছে সেটা জানা বিশেষ দরকার।’

বরাট গাত্ৰোত্থান করিয়া বলিল,–’আজ থেকেই লোক লাগাবো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পানুর ব্যাপারে সব গোলমাল হয়ে গেছে। কাল থেকে হবে। —কলোনীতে আর কারুর হঠাৎ মৃত্যুর যোগ নেই তো?’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’বোধহয় না। থাকলেও আমরা ঠেকাতে পারব না।’

১৮

দুইদিন গোলাপ কলোনীর দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসিল না; প্রমোদ বরািটও খবর দিল। না। মৃত্যু-ছায়াচ্ছন্ন কলোনীর কথা যেন সকলে ভুলিয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ টেলিফোনের দিকে চোখ রাখিয়া অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। দু’একবার আমরা দাবার ছক সাজাইয়া বসিলাম। কিন্তু ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক হইয়া রহিল‌, খেলা জমিল না।

তৃতীয় দিন বিকালবেলা চা-পানের পর ব্যোমকেশ বলিল,–’আমি একটু বেরুব।’

আমারও মন চঞ্চল হইয়া উঠিল‌, বলিলাম,–’কোথায় যাবে?’

‘সেন্ট মার্থার স্কুলে খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। তুমি কিন্তু বাড়িতেই থাকবে। যদি টেলিফোন আসে।’

ব্যোমকেশ চলিয়া গেল। তারপর দুঘন্টা কড়িকাঠ গুনিয়া কাটাইয়া দিলাম।

ছটা বাজিতে পাঁচ মিনিটে টেলিফোন বাজিল। বুকের ভিতরটা ছাৎ করিয়া উঠিল।

বরাট টেলিফোন করিতেছে। বলিল,–’বেরিয়েছেন?–তাঁকে বলে দেবেন। ভুজঙ্গধরবাবু কোট-প্যান্ট পরে পৌঁনে ছাঁটার ট্রেনে কলকাতা গেছেন।–আর একটা খবর আছে‌, রসিক দে’র খতাপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে তিন হাজার টাকার গরমিল। রসিকের নামে ওয়ারেন্ট বার করেছি।’

‘কলোনীর খবর কী?’

‘নতুন খবর কিছু নেই।’

বরাট টেলিফোন ছাড়িয়া দিবার পর মনটা আরও অস্থির হইয়া উঠিল। ভুজঙ্গধরবাবু কলিকাতায় আসিতেছেন এ সংবাদের গুরুত্ব কতখানি কিছুই জানি না। ব্যোমকেশ কখন ফিরিবে?

ব্যোমকেশ ফিরিল সওয়া ছাঁটার সময়। ভুজঙ্গধরবাবুর সংবাদ দিতেই তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল‌, সে হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, —’ট্রেন এসে পৌঁছতে এখনও আধা ঘন্টা। অনেক সময় আছে।’ বলিয়া নিজের শয়নকক্ষে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

আমি দ্বারের নিকট হইতে বলিলাম,–’রসিক দে দোকানের তিন হাজার টাকা মেরেছে।’

ওপার হইতে আওয়াজ আসিল,–’বেশ বেশ।’

পাঁচ মিনিট পরে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল একটি আধাবয়সী ফিরিঙ্গী। পরিধানে ময়লা জিনের প্যান্টুলুন ও রঙচটা আলপাকার কোট‌, মাথায় তেল-চিট নাইট ক্যাপ‌, ছাঁটা গোঁফের ভিতর হইতে আধ-পোড়া একটা চুরুট বাহির হইয়া আছে।

বলিলাম,–’এ কি গোয়াঞ্চি পিদ্রু সেজে কোথায় চললে?’

সাহেব কড়া সুরে বলিল, —’None of your business‌, young man.’ বলিয়া পা ঘষিয়া বাহির হইয়া গেল।

তারপর সাড়ে দশটার আগে আর তাহার দেখা পাইলাম না। একেবারে স্নান সারিয়া গরম চায়ের পেয়ালা হাতে বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিল।

আমি বলিলাম,–’কোট-প্যান্টুলুনের আর একটা মহৎ গুণ‌, পরলেই মেজাজ। সপ্তমে চড়ে যায়। আশা করি মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’কোট-প্যান্টুলুনের আর একটা মহৎ গুণ‌, বেশি ছদ্মবেশ দরকার হয় না।–তুমি বোধহয় খুবই উৎসুক হয়ে উঠেছ?’

‘তা উঠেছি। এবার তোমার হৃদয়ভার লাঘব কর।’

‘কোনটা আগে বলব? ভুজঙ্গধরবাবুর বৃত্তান্ত?’

‘হ্যাঁ।‘

ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল,–’বুঝতেই পেরেছ ফিরিঙ্গী সেজে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ভুজঙ্গধরবাবু কোথায় যান দেখা। স্টেশনে তাঁকে আবিষ্কার করে তাঁর পিছু নিলাম। তখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। তাঁকে অনুসরণ করা শক্ত হল না। তিনি ট্রামে চড়লেন‌, আমিও ট্রামে চড়লাম। মৌলালির মোড়ে এসে তিনি নামলেন‌, আমিও নোমলাম। তারপর ধর্মতলা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তিনি একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। গলির পর গলি‌, তস্য গলি। দেখলাম ফিরিঙ্গী পাড়ায় এসে পৌঁছেছি। ভালই হল। পাড়ার সঙ্গে আমার ছদ্মবেশ খাপ খেয়ে গেল। কোট-প্যান্টুলুনের ওই মাহাত্ম্য, যে পাড়াতেই যাও বেমানান হয় না।‘

0 Shares