চিড়িয়াখানা

‘তারপর?’

‘একটা এদোঁপড়া বাড়ির দরজার পাশে দুটো স্ত্রীলোক দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভুজঙ্গধরবাবু গিয়ে তাদের সঙ্গে খাটো গলায় কথা বললেন‌, তারপর বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। স্ত্রীলোক দুটো দাঁড়িয়ে রইল।’

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’তাদের কি রকম মনে হল?’

ব্যোমকেশের মুখে বিতৃষ্ণা ফুটিয়া উঠিল‌, সে বলিল

‘দেবতা ঘুমালে তাঁহাদের দিন

দেবতা জাগিলে তাদের রাতি

ধরার নরক সিংহদুয়ারে

জ্বালায় তাহারা সন্ধ্যাবাতি!’

‘তারপর বল।’

‘আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেলাম। ভুজঙ্গধরবাবুর চরিত্র আমরা যতটা জানতে পেরেছি। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। কিন্তু এই এঁদোপড়া বাড়িটাই তাঁর একমাত্র গন্তব্যস্থল কিনা তা না জেনে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমি বাড়ির সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গেলাম‌, দেখে নিলাম বাড়ির নম্বর উনিশ। তারপর একটা অন্ধকার কোণে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মেয়ে দুটো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগল।

‘প্ৰায় চল্লিশ মিনিট পরে ভুজঙ্গধরবাবু বেরুলেন। আশেপাশে দৃকপাত না করে যে-পথে এসেছিলেন। সেই পথে ফিরে চললেন। আমি চললাম। তারপর সটান শেয়ালদা স্টেশনে তাঁকে নটা পঞ্চান্নর গাড়িতে তুলে দিয়ে আসছি।’

চায়ের পেয়ালা এক চুমুকে শেষ করিয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল। আমি বলিলাম‌, ‘তাহলে ভুজঙ্গধরবাবুর কার্যকলাপ থেকে কিছু ধরা গেল না?’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’কেমন যেন ধোঁকা লাগল। ভুজঙ্গধরবাবু যখন দরজা থেকে বেরুলেন তখন তাঁর পকেট থেকে কি একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। বিনিৎ করে শব্দ হল। তিনি দেশলাই জ্বেলে সেটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন। দেখলাম। একটা চাবির রিঙ‌, তাতে গোটা তিনেক বড়-বড় চাবি রয়েছে।’

‘এতে ধোঁকা লাগাবার কি আছে?’

‘হয়তো কিছু নেই‌, তবু ধোঁকা লাগছে।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর বলিলাম,–’ওদিকে কী হল? সেন্ট মার্থা স্কুল?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’দময়ন্তী দেবী মাস আষ্টেক স্কুলে যাতায়াত করেছিলেন। রোজ যেতেন না‌, ইংরেজি শেখার দিকেও খুব বেশি চাড় ছিল না। স্কুলে দু’ তিনটি পাঞ্জাবী মেয়ে পড়ত‌, তাদের সঙ্গে গল্প করতেন–’

‘পাঞ্জাবী মেয়েদের সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ। দময়ন্তী দেবী পাঞ্জাবী ভাষা জানেন।’

এই সময়ে টেলিফোন বাজিল। ব্যোমকেশ টপ করিয়া ফোন তুলিয়া লইল,–’হ্যালো…ইন্সপেক্টর বিরাট! এত রাত্রে কী খবর?..রসিক দে ধরা পড়েছে! কোথায় ছিল.অ্যাঁ। শিয়ালদার কাছে ‘বঙ্গ বিলাসী হোটেলে! সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু ছিল?…মাত্র ত্রিশ টাকা …আজ তাকে আপনাদের লক-আপে রাখুন‌, কাল সকালেই আমি গিয়ে হাজির হব। …আর কি! হ্যাঁ দেখুন‌, একটা ঠিকানা দিচ্ছি‌, আপনার একজন লোক পাঠিয়ে সেখানকার হালচাল সব সংগ্ৰহ করতে হবে…১৯ নম্বর মিজ লেন…হ্যাঁ‌, স্থানটা খুব পবিত্র নয়…কিন্তু সেখানে গিয়ে আলাপ জমাবার মতন লোক আপনাদের বিভাগে নিশ্চয় আছে…হাঃ হাঃ হাঃ…আচ্ছা‌, কাল সকালেই যাচ্ছি…নমস্কার।’

ফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’চল‌, আজ খেয়ে-দোয়ে শুয়ে পড়া যাক‌, কাল ভোরে উঠতে হবে।’

১৯

গোলাপ কলোনীর ঘটনাবলী ধাবমান মোটরের মত হঠাৎ বানচাল হইয়া রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল‌, তিন দিন পরে মেরামত হইয়া আবার প্রচণ্ড বেগে ছুটিতে আরম্ভ করিল।

পরদিন সকালে আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় মোহনপুরের স্টেশনে অবতীর্ণ হইলাম। আকাশে শেষরাত্রি হইতে মেঘ জমিতেছিল‌, সূর্য ছাই-ঢাকা আগুনের মত কেবল অস্তদাহ বিকীর্ণ করিতেছিলেন। আমরা পদব্রজে থানার দিকে চলিলাম।

থানার কাছাকাছি পৌঁছিয়াছি। এমন সময় নেপালবাবু বন্য বরাহের ন্যায় থানার ফটক দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। আমাদের দিকে মোড় ঘুরিয়া ছুটিয়া আসিতে আসিতে হঠাৎ আমাদের দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন‌, তারপর আবার ঘোঁৎ ঘোৎ করিয়া ছুটিয়া চলিলেন।

ব্যোমকেশ ডাকিল,–’নেপালবাবু্‌, শুনুন-শুনুন।’

নেপালবাবু যুযুৎসু ভঙ্গীতে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া চক্ষু ঘূর্ণিত করিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহার কাছে গিয়া বলিল,–’এ কি‌, আপনি থানায় গিয়েছিলেন। কী হয়েছে?’

নেপালবাবু ফাটিয়া পড়িলেন,–’ঝকমারি হয়েছে! পুলিসকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম,  আমার ঘাট হয়েছে। পুলিসের খুরে দণ্ডবৎ।’ বলিয়া আবার উল্টামুখে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

ব্যোমকেশ আবার গিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল,–’কিন্তু ব্যাপারটা কি? পুলিসকে কোন বিষয়ে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন?’

ঊর্ধ্বে হাত তুলিয়া নাড়িতে নাড়িতে নেপালবাবু বলিলেন,–’না না‌, আর না‌, যথেষ্ট হয়েছে। কোন শালা আর পুলিসের কাজে মাথা গলায়। আমার দুবুদ্ধি হয়েছিল‌, তাই—!’’

ব্যোমকেশ বলিল,–’কিন্তু আমাকে বলতে দোষ কি? আমি তো আর পুলিস নাই।’

নেপালবাবু্‌, কিন্তু বাগ মানিতে চান না। অনেক কষ্টে পিঠে অনেক হাত বুলাইয়া ব্যোমকেশ তাঁহাকে কতকটা ঠাণ্ডা করিল। একটা গাছের তলায় দাঁড়াইয়া কথা হইল। নেপালবাবু বলিলেন,–’কলোনীতে দুটো খুন হয়ে গেল‌, পুলিস চুপ করে বসে থাকতে পারে কিন্তু আমি চুপ করে থাকি কি করে? আমার তো একটা দায়িত্ব আছে! আমি জানি কে খুন করেছে‌, তাই পুলিসকে বলতে গিয়েছিলাম। তা পুলিস উল্টে আমার ওপরই চাপ দিতে লাগল। ভাল রে ভাল-যেন আমিই খুন করেছি।’

ব্যোমকেশ বলিল, —’আপনি জানেন কে খুন করেছে?’

‘এর আর জানাজানি কি? কলোনীর সবাই জানে‌, কিন্তু মুখ ফুটে বলবার সাহস কারুর নেই।’

0 Shares