‘কে খুন করেছে?’
‘বিজয়! বিজয়! আর কে খুন করবে? খুড়ীর সঙ্গে ষড় করে আগে খুড়োকে সরিয়েছে, তারপর পানুকে সরিয়েছে। পানুটাও দলে ছিল কিনা।’
‘কিন্তু–পানু কিসে মারা গেছে আপনি জানেন?’
‘নিকোটিন। আমি সব খবর রাখি।’
‘কিন্তু বিজয় নিকোটিন পাবে কোথায়? নিকোটিন কি বাজারে পাওয়া যায়?’
‘বাজারে সিগারেট তো পাওয়া যায়। যার ঘটে এতটুকু বুদ্ধি আছে সে এক প্যাকেট সিগারেট থেকে এত নিকোটিন বার করতে পারে যে কলোনী সুদ্ধ লোককে তা দিয়ে সাবাড় করা যায়।’
‘তাই নাকি? নিকোটিন তৈরি করা এত সহজ?’
‘সহজ নয় তো কী! একটা বকযন্ত্র যোগাড় করতে পারলেই হল।’ এই পর্যন্ত বলিয়া নেপালবাবু হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিলেন, তারপর আর বাক্যব্যয় না করিয়া স্টেশনের দিকে পা চালাইলেন।
আমরাও সঙ্গে চলিলাম! ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনি বৈজ্ঞানিক, আপনার কথাই ঠিক। আমি জানতাম না নিকোটিন তৈরি করা এত সোজা।–তা আপনি এদিকে কোথায় চলেছেন? কলোনীতে ফিরবেন না?’
‘কলকাতা যাচ্ছি একটা বাসা ঠিক করতে-কলোনীতে ভদরলোক থাকে না—’ বলিয়া তিনি হনহন করিয়া চলিয়া গেলেন।
আমরা থানার দিকে ফিরিলাম। ব্যোমকেশের ঠোঁটের কোণে একটা বিচিত্ৰ হাসি খেলা করিতে লাগিল।
থানায় প্রমোদ বরাটের ঘরে আসন গ্ৰহণ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’রাস্তায় নেপাল গুপ্তর সঙ্গে দেখা হল।’
বরাট বলিল,–’আর বলবেন না, লোকটা বদ্ধ পাগল। সকাল থেকে আমার হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে। ওর বিশ্বাস বিজয় খুন করেছে, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণ কিছু নেই, শুধু আক্ৰোশ। আমি বললাম, আপনি যদি বিজয়ের নামে পুলিসে ডায়েরি করতে চান আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পরে যদি বিজয় মানহানির মামলা করে তখন আপনি কি করবেন? এই শুনে নেপাল গুপ্ত উঠে পালাল। আসল কথা বিজয় ওকে নোটিস দিয়েছে; বলেছে চুপটি করে কলোনীতে থাকতে পারেন তো থাকুন, নইলে রাস্তা দেখুন, সদারি করা এখানে চলবে না। তাই এত রাগ।’
ব্যোমকেশ বলিল, —’আমারও তাই আন্দাজ হয়েছিল।—যাক, এবার আপনার রসিককে বার করুন।’
রসিক আনীত হইল। হাজতে রাত্রিবাসের ফলে তাহার চেহারার শ্ৰীবৃদ্ধি হয় নাই। খুঁতখুঁতে মুখে নিপীড়িত একগুঁয়েমির ভাব। আমাদের দেখিয়া একবার ঢোক গিলিল, কণ্ঠার হাড় সবেগে নড়িয়া উঠিল।
কিন্তু তাহাকে জেরা করিয়া ব্যোমকেশ কোনও কথাই বাহির করিতে পারিল না। বস্তুত রসিক প্রায় সারাক্ষণই নিবাক হইয়া রহিল। সে চুরি করিয়াছে কি না এ প্রশ্নের জবাব নাই, টাকা লইয়া কী করিল। এ বিষয়েও নিরুত্তর। কেবল একবার সে কথা কহিল, তাহাও প্রায় অজ্ঞাতসারে।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’যে-রাত্রে নিশানাথবাবু মারা যান সেদিন সন্ধ্যেবেলা তাঁর সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়েছিল?’
রসিক চোখ মেলিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, বলিল,–’নিশানাথবাবু মারা গেছেন?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’হ্যাঁ। পানুগোপালও মারা গেছে। আপনি জানেন না?’
রসিক কেবল মাথা নাড়িল। তারপর ব্যোমকেশ আরও প্রশ্ন করিল। কিন্তু উত্তর পাইল না। শেষে বলিল,–’দেখুন, আপনি চুরির টাকা নষ্ট করেননি, কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। আপনি যদি আমাদের জানিয়ে দেন কোথায় টাকা রেখেছেন তাহলে আমি বিজয়বাবুকে বলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা তুলিয়ে নেব, আপনাকে জেলে যেতে হবে না।–কোথায় কার কাছে টাকা রেখেছেন বলবেন কি?’
রসিক পূর্ববৎ নিবাক হইয়া রহিল।
আরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ব্যোমকেশ হাল ছাড়িয়া দিল। বলিল,–’আপনি ভাল করলেন না। আপনি যে-কথা লুকোবার চেষ্টা করছেন তা আমরা শেষ পর্যন্ত জানতে পারবই। মাঝ থেকে আপনি পাঁচ বছর জেল খাটবেন।’
রসিকের কণ্ঠার হাড় আর একবার নড়িয়া উঠিল, সে যেন কিছু বলিবার জন্য মুখ খুলিল। তারপর আবার দৃঢ়ভাবে ওষ্ঠাধর সম্বদ্ধ করিল।
রসিককে স্থানান্তরিত করিবার পর ব্যোমকেশ শুষ্কম্বরে বলিল,–’এদিকে তো কিছু হল না-কিন্তু আর দেরি নয়, সব যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে—‘
বরাট বলিল,–’কী প্ল্যান?’
প্ল্যান কিন্তু শোনা হইল না। এই সময় একটি বাঁকাটে ছোকরা গোছের চেহারা দরজা দিয়া মুণ্ড বাড়াইয়া বলিল,–’ব্ৰজদাস বোষ্টমকে পাকড়েছি স্যার।’
বরাট বলিল,–’বিকাশ! এস। কোথায় পাকড়ালে বোষ্টমকে?’
বিকাশ ঘরে প্রবেশ করিয়া দন্তবিকাশ করিল,–’নবদ্বীপের এক আখড়ায় বসে খঞ্জনি বাজাচ্ছিল। কোনও গোলমাল করেনি। যেই বললাম, আমার সঙ্গে ফিরে যেতে হবে, অমনি সুসসুড় করে চলে এল।’
‘বাঃ বেশ। এই ঘরেই পাঠিয়ে দাও তাকে।’
ব্ৰজদাস বৈষ্ণব ঘরে প্রবেশ করিলেন। গায়ে নামাবলী, মুখে কয়েক দিনের অক্ষৌরিত দাড়ি-গোঁফ মুখখানিকে ধুতরা-ফলের মত কন্টকাকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে, চোখে লজ্জিত অপ্রস্তুত ভাব। তিনি বিনয়াবনত হইয়া জোড়হস্তে আমাদের নমস্কার করিলেন।
বরাট ব্যোমকেশকে চোখের ইশারা করিল, ব্যোমকেশ ব্রজদাসের দিকে মুচকি হাসিয়া বলিল,–’বসুন।’
ব্ৰজদাস যেন আরও লজ্জিত হইয়া একটি টুলের উপর বসিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনি হঠাৎ ডুব মেরেছিলেন কেন বলুন তো? যতদূর জানি কলোনীর টাকাকড়ি কিছু আপনার কাছে ছিল না।’
ব্ৰজদাস বলিলেন,–’আজ্ঞে না।’
‘তবে পালালেন কেন?’
ব্ৰজদাস, কচুমাচু মুখে চুপ করিয়া রহিলেন। তাহার মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, নিশানাথ বলিয়াছিলেন ব্ৰজদাস মিথ্যা কথা বলে না। ইহাও কি সম্ভব? পাছে সত্য কথা বলিতে হয় এই ভয়ে তিনি পলায়ন করিয়াছিলেন। কিন্তু কী এমন মারাত্মক সত্য কথা?