চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’আচ্ছা‌, ওকথা পরে হবে। এখন বলুন দেখি‌, নিশানাথবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানেন?’

ব্ৰজদাস বলিলেন,–’না‌, কিছু জানি না।’

‘কাউকে সন্দেহ করেন?’

‘আজ্ঞে না।‘

‘তবে–ব্যোমকেশ থামিয়া গিয়া বলিল,–’নিশানাথবাবুর মৃত্যুর রাত্রে আপনি কলোনীতেই ছিলেন তো?’

‘আজ্ঞে কলোনীতেই ছিলাম।’

লক্ষ্য করিলাম ব্ৰজদাস এতক্ষণে যেন বেশ স্বচ্ছন্দ হইয়াছেন‌, কচুমাচু ভাব আর নাই। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কোথায় ছিলেন‌, কি করছিলেন?’

ব্ৰজদাস বলিলেন,–’আমি আর ডাক্তারবাবু একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে এলাম‌, উনি নিজের কুঠিতে গিয়ে সেতার বাজাতে লাগলেন‌, আমি নিজের দাওয়ায় শুয়ে তাঁর বাজনা শুনলাম!’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল,–’ও।–ভুজঙ্গধরবাবু সেতার বাজাচ্ছিলেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, মালকোষের আলাপ করছিলেন।’

‘কতক্ষণ আলাপ করেছিলেন?’

‘তা প্ৰায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। চমৎকার হাত ওঁর।’

‘হুঁ। একটানা আলাপ করেছিলেন? একবারও থামেননি?

‘আজ্ঞে না‌, একবারও থামেননি।‘

‘পাঁচ মিনিটের জন্যেও নয়?’

‘আজ্ঞে না। সেতারের কান মোচ্‌ড়াববার জন্য দু’একবার থেমেছিলেন‌, তা সে পাঁচ-দশ সেকেন্ডের জন্য‌, তার বেশি নয়।’

‘কিন্তু আপনি তাঁকে বাজাতে দেখেননি?’

‘দেখব কি করে? উনি অন্ধকারে বসে বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি ওঁর আলাপ চিনি‌, উনি ছাড়া আর কেউ নয়।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বিফল হইয়া রহিল‌, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করিল।–

‘আপনি কলোনীতে আসবার আগে থেকেই নিশানাথবাবুকে চিনতেন?’

আবার ব্ৰজদাসের মুখ শুকাইল। তিনি উসখুসি করিয়া বলিলেন,–’আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপনি ওঁর সেরেস্তায় কাজ করতেন‌, উনি সাক্ষী দিয়ে আপনাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, আমি চুরি করেছিলাম।’

‘বিজয় তখন নিশানাথবাবুর কাছে থাকত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘দময়ন্তী দেবীর তখন বিয়ে হয়েছিল?’

ব্ৰজদাসের মুখ কাঁদো-কাঁদো হইয়া উঠিল‌, তিনি ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’উত্তর দিচ্ছেন না যে? দময়ন্তী দেবীকে তখন থেকেই চেনেন তো?’

ব্ৰজদাস অস্পষ্টভাবে হ্যাঁ বলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’তার মানে নিশানাথ আর দময়ন্তীর বিয়ে তার আগেই হয়েছিল—কেমন?’

ব্ৰজদাস এবার ব্যাকুল স্বরে বলিয়া উঠিলেন,-‘এই জন্যেই আমি পালিয়েছিলাম। আমি জানতাম আপনারা এই কথা তুলবেন। দোহাই ব্যোমকেশবাবু, আমাকে ও প্রশ্ন করবেন না। আমি সাত বছর ওঁদের অন্ন খেয়েছি। আমাকে নিমকহারামি করতে বলবেন না। ’ বলিয়া তিনি কাতরভাবে হাত জোড় করিলেন।

ব্যোমকেশ সোজা হইয়া বসিল, তাহার চোখের দৃষ্টি বিস্ময়ে প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল,-’এ সব কী ব্যাপার?

ব্ৰজদাস ভগ্নস্বরে বলিলেন,-’আমি জীবনে অনেক মিথ্যে কথা বলেছি, আর মিথ্যে কথা বলব না। জেল থেকে বেরিয়ে আমি বৈষ্ণব হয়েছি, কণ্ঠি নিয়েছি ; কিন্তু শুধু কঠি নিলেই তো হয় না, প্ৰাণে ভক্তি কোথায়, প্রেম কোথায়? তাই প্রতিজ্ঞা করেছি। জীবনে আর মিথ্যে কথা বলব না, তাতে যদি ঠাকুরের কৃপা হয়। —আপনারা আমায় দয়া করুন, ওঁদের কথা জিগ্যেস করবেন না। ওঁরা আমার মা বাপ।’

ব্যোমকেশ ধীরস্বরে বলিল,-‘আপনার কথা শুনে এইটুকু বুঝলাম যে আপনি মিথ্যে কথা বলেন না, কিন্তু নিশানাথ সম্বন্ধে সত্যি কথা বলতেও আপনার সঙ্কোচ হচ্ছে। মিথ্যে কথা না বলা খুবই প্রশংসার কথা, কিন্তু সত্যি কথা গোপন করায় কোনও পুণ্য নেই। ভেবে দেখুন, সত্যি কথা না জানলে আমরা নিশানাথবাবুর খুনের কিনারা করব কি করে? আপনি কি চান না যে নিশানাথবাবুর খুনের কিনারা হয়?’

ব্ৰজদাস নতমুখে রহিলেন। তারপর আমরা সকলে মিলিয়া নির্বন্ধ করিলে তিনি অসহায়ভাবে বলিলেন,-‘কি জানতে চান বলুন।‘

ব্যোমকেশ বলিল,-‘নিশানাথ ও দময়ন্তীর বিয়ের ব্যাপারে কিছু গোলমাল আছে। কী গোলমাল?’

‘ওঁদের বিয়ে হয়নি।’

বোকার মত সকলে চাহিয়া রহিলাম।

ব্যোমকেশ প্ৰথমে সামলাইয়া লইল। তারপর ধীরে ধীরে একটি একটি প্রশ্ন করিয়া ব্ৰজদাস বাবাজীর নিকট হইতে যে কাহিনী উদ্ধার করিল। তাহা এই–

নিশানাথবাবু পুণায় জজ ছিলেন, ব্ৰজদাস ছিলেন তাঁর সেরেস্তার কেরানি। লাল সিং নামে একজন পাঞ্জাবী খুনের অপরাধে দায়রা-সোপর্দ হইয়া নিশানাথবাবুর আদালতে বিচারার্থ আসে। দময়ন্তী এই লাল সিং-এর স্ত্রী।

নিশানাথের কোর্টে যখন দায়রা মোকদ্দমা চলিতেছে তখন দময়ন্তী নিশানাথের বাংলোতে আসিয়া সকাল-সন্ধ্যা বসিয়া থাকিত, কান্নাকাটি করিত। নিশানাথ তাহাকে তাড়াইয়া দিতেন, সে আবার আসিত। বলিত, আমি অনাথা, আমার স্বামীর সাজা হইলে আমি কোথায় যাইব?

দময়ন্তীর বয়স তখন উনিশ-কুড়ি; অপরূপ সুন্দরী। বিজয়ের বয়স তখন তেরো-চৌদ্দ, সে দময়ন্তীর অতিশয় অনুগত হইয়া পড়িল। কাকার কাছে দময়ন্তীর জন্য দরবার করিত। নিশানাথ কিন্তু প্রশ্রয় দিতেন না। বিজয় যে, দময়ন্তীকে চুপি চুপি খাইতে দিতেছে এবং রাত্রে বাংলোতে লুকাইয়া রাখিতেছে তাহা তিনি জানিতে পারিতেন না।

লাল সিং-এর ফাঁসির হুকুম হইয়া যাইবার পর নিশানাথ জানিতে পারিলেন। খুব খানিকটা বকাবকি করিলেন এবং দময়ন্তীকে অনাথ আশ্রমে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। দময়ন্তী কিন্তু তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল, বালক বিজয়ও চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। নিরুপায় হইয়া নিশানাথ দময়ন্তীকে বাংলোয় থাকিতে দিলেন। বাড়ির চাকর-বাকরের কাছে ব্ৰজদাস এই সকল সংবাদ পাইয়াছিলেন।

0 Shares