চিড়িয়াখানা

হাইকোর্টের আপীলে লাল সিং-এর ফাঁসির হুকুম রদ হইয়া যাবজীবন কারাবাস হইল। দময়ন্তী নিশানাথের আশ্রয়ে রহিয়া গেল। হাকিম-হুকুম মহলে এই লইয়া একটু কানাঘুষা হইল। কিন্তু নিশানাথের চরিত্র-খ্যাতি এতাই মজবুত ছিল যে‌, প্রকাশ্যে কেহ তাঁহাকে অপবাদ দিতে সাহস করিল না।

ইহার দু’এক মাস পরে ব্ৰজদাসের চুরি ধরা পড়িল; নিশানাথ সাক্ষী দিয়া তাঁহাকে জেলে পাঠাইলেন। তারপর কয়েক বৎসর কী হইল ব্ৰজদাস তাহা জানেন না।

ব্ৰজদাস জেল হইতে বাহির হইয়া শুনিলেন নিশানাথ কর্ম হইতে অবসর লইয়াছেন‌, তিনি নিশানাথের সন্ধান লাইতে লাগিলেন। জেলে থাকাকালে ব্ৰজদাসের মতিগতি পরিবর্তিত হইয়াছিল‌, তিনি বৈষ্ণব হইয়াছিলেন। সন্ধান করিতে করিতে তিনি গোলাপ কলোনীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

এখানে আসিয়া ব্ৰজদাস দেখিলেন নিশানাথ ও দময়ন্তী স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করিতেছেন। নিশানাথ তাঁহাকে কলোনীতে থাকিতে দিলেন‌, কিন্তু সাবধান করিয়া দিলেন‌, দময়ন্তীঘটিত কোনও কথা যেন প্রকাশ না পায়। দময়ন্তী ও বিজয় পূর্বে ব্ৰজদাসকে এক-আধবার দেখিয়াছিল‌, এতদিন পরে তাঁহাকে চিনিতে পারিল না! তদবধি ব্ৰজদাস কলোনীতে আছেন। নিশানাথ ও দময়ন্তীর মত মানুষ সংসারে দেখা যায় না। তাঁহারা যদি কোনও পাপ করিয়া থাকেন। ভগবান তাহার বিচার করিবেন।

ব্যোমকেশ সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,–’ইন্সপেক্টর বরাট‌, চলুন। একবার কলোনীতে যাওয়া যাক। অন্ধকার অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে।’

ব্ৰজদাস করুণ স্বরে বলিলেন,—’আমার এখন কী হবে?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনিও কলোনীতে চলুন। যেমন ছিলেন তেমনি থাকবেন।’

২০

প্ৰমোদ বরাটের ঘর হইতে যখন বাহিরে আসিলাম বেলা তখন প্ৰায় বারোটা। পাশের ঘরে থানার কয়েকজন কর্মচারী খাতা-পত্র লইয়া কাজ করিতেছিল, বরাট বাহিরে আসিলে হেড-ক্লার্ক উঠিয়া আসিয়া নিম্নস্বরে বিরাটকে কিছু বলিল।

বরাট ব্যোমকেশকে বলিল,–’একটু অসুবিধা হয়েছে। আমাকে এখনি আর একটা কাজে বেরুতে হবে। তা আপনার না হয় এগোন‌, আমি বিকেলের দিকে কলোনীতে হাজির হব।’

ব্যোমকেশ একটু চিস্তা করিয়া বলিল,–’তার চেয়ে এক কাজ করা যাক‌, সন্ধ্যের সময় সকলে একসঙ্গে গেলেই চলবে। আপনি কাজে যান‌, সন্ধ্যে ছাঁটার সময় স্টেশনে ওয়েটিং রুমে আমাদের খোঁজ করবেন।’

বরাট বলিল,–’বেশ‌, সেই ভাল।’

ব্ৰজদাস বলিলেন,–’কিন্তু আমি—‘

ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনি এখন কলোনীতে ফিরে যেতে পারেন‌, কিন্তু যে-সব কথা হল তা কাউকে বলবার দরকার নেই।’

‘যে আজ্ঞে।’

ব্ৰজদাস কলোনীর রাস্তা ধরিলেন‌, আমরা স্টেশনে ফিরিয়া চলিলাম। চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ বলিল,–’আমাদের চোখে ঠুলি আঁটা ছিল। দময়ন্তী নামটা প্রচলিত বাংলা নাম নয় এটাও চোখে পড়েনি। অমন রঙ এবং রূপ যে বাঙালীর ঘরে চোখে পড়ে না। এ কথাও একবার ভেবে দেখিনি। দময়ন্তী এবং নিশানাথের বয়সের পার্থক্য থেকে কেবল দ্বিতীয় পক্ষই আন্দাজ করলাম‌, অন্য সম্ভাবনা যে থাকতে পারে তা ভাবলাম না। দময়ন্তী স্কুলে গিয়ে পাঞ্জাবী মেয়েদের সঙ্গে গল্প করেন এ থেকেও কিছু সন্দেহ হল না। অথচ সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। নিশানাথবাবু বোম্বাই প্রদেশে সাতচল্লিশ বছর বয়সে একটি উনিশ-কুড়ি বছরের বাঙালী তরুণীকে বিয়ে করলেন এটা এক কথায় মেনে নেবার মত নয়।–অজিত‌, মাথার মধ্যে ধূসর পদার্থ ক্রমেই ফ্যাকাসে হয়ে আসছে‌, এবার অবসর নেওয়া উচিত। সত্যান্বেষণ ছেড়ে ছাগল চরানো কিম্বা অনুরূপ কোনও কাজ করার সময় উপস্থিত হয়েছে।’

তাহার ক্ষোভ দেখিয়া হাসি আসিল। বলিলাম,–’ছাগল না হয়। পরে চরিও‌, আপাতত এ ব্যাপারের তো একটা নিম্পত্তি হওয়া দরকার। দময়ন্তী নিশানাথবাবুর স্ত্রী নয় এ থেকে কী বুঝলে?’

ক্ষুব্ধ ব্যোমকেশ কিন্তু উত্তর দিল না।

স্টেশনে ওয়েটিং রুমে তালা লাগানো ছিল‌, তালা খোলাইয়া ভিতরে গিয়া বসিলাম। একটা কুলিকে দিয়া বাজার হইতে কিছু হিঙের কচুরি ও মিষ্টান্ন আনাইয়া পিত্ত রক্ষা করা গেল।

আকাশে মেঘ। আরও ঘন হইয়াছে‌, মাঝে মাঝে চড়বড় করিয়া দু’চার ফোঁটা ছাগল-তাড়ানো বৃষ্টি ঝরিয়া পড়িতেছে। সন্ধ্যা নাগাদ বেশ চাপিয়া বৃষ্টি নামিবে মনে হইল।

দুইটি দীর্ঘবাহু আরাম-কেন্দারায় আমরা লম্বা হইলাম। বাহিরে থাকিয়া থাকিয়া ট্রেন আসিতেছে। যাইতেছে। আমি মাঝে মাঝে বিমাইয়া পড়িতেছি‌, মনের মধ্যে সূক্ষ্ম চিন্তার ধারা বহিতেছে-দময়ন্তী দেবী নিশানাথের স্ত্রী নয়‌, লাল সিং-এর স্ত্রী…মানসিক অবস্থার কিরূপ বিবর্তনের ফলে একজন সচ্চরিত্র সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এরূপ কর্ম করিতে পারেন?…দময়ন্তী প্রকৃতপক্ষে কিরূপ স্ত্রীলোক? স্বৈরিণী? কুহকিনী? কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তাহা মনে হয় না…

সাড়ে পাঁচটার সময় পুলিস ভ্যান লইয়া বরাট আসিল। আকাশের তখন এমন অবস্থা হইয়াছে যে‌, মনে হয়। রাত্রি হইতে আর দেরি নাই। মেঘগুলা ভিজা ভোট-কম্বলের মত আকাশ আবৃত করিয়া দিনের আলো মুছিয়া দিয়াছে।

বরাট বলিল,–’বিকাশকে আপনার উনিশ নম্বর মিজ লেনে পাঠিয়ে দিলাম। কাল খবর পাওয়া যাবে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’বিকাশ! ও-বেশ বেশ। ছোকরা কি আপনাদের দলের লোক‌, অর্থাৎ পুলিসে কাজ করে?’।

বরাট বলিল,–’কাজ করে বটে। কিন্তু ইউনিফর্ম পরতে হয় না। ভারী খলিফা ছেলে। চলুন‌, এবার যাওয়া যাক।।’

স্টেশনের স্টলে এক পেয়ালা করিয়া চা গলাধঃকরণ করিয়া আমরা বাহির হইতেছি‌, একটা ট্রেন কলিকাতার দিক হইতে আসিল। দেখিলাম নেপালবাবু গাড়ি হইতে নামিলেন‌, হনহন করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। আমাদের দেখিতে পাইলেন না।

0 Shares