চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’উনি এগিয়ে যান। আমরা আধা ঘন্টা পরে বেরুব।’

আমরা আবার ওয়েটিং রুমে গিয়া বসিলাম। একথা-সেকথায় আধা ঘণ্টা কাটাইয়া মোটর ভ্যানে চড়িয়া বাহির হইয়া পড়িলাম।

কলোনীর ফটক পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই ব্যোমকেশ বলিল,–’এখানেই গাড়ি থামাতে বলুন‌, গাড়ি ভেতরে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। অনর্থক সকলকে সচকিত করে তোলা হবে।’

গাড়ি থামিল‌, আমরা নামিয়া পড়িলাম। অন্ধকার আরও গাঢ় হইয়াছে। আমরা কলোনীর ফটকের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম নিশানাথবাবুর ঘরের পাশের জানোলা দিয়া আলো আসিতেছে।

ব্যোমকেশ সদর দরজার কড়া নাড়িল। বিজয় দরজা খুলিয়া দিল এবং আমাদের দেখিয়া চমকিয়া বলিয়া উঠিল,–’আপনারা।’

ভিতরে দময়ন্তী চেয়ারে বসিয়া আছেন দেখা গেল। ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলিল,–’দিময়ন্তী দেবীকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে।’

আমাদের ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া দময়ন্তী ত্ৰস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, তাঁহার মুখ ব্বির্ণ হইয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল,–’উঠবেন না। বিজয়বাবু্‌, আপনিও বসুন।’

দয়মন্তী ধীরে ধীরে আবার বসিয়া পড়িলেন। বিজয় চোখে শঙ্কিত সন্দেহ ভরিয়া তাঁহার চেয়ারের পিছনে গিয়া দাঁড়াইল।

আমরা উপবিষ্ট হইলাম! ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’বাড়িতে আর কেউ নেই?’

বিজয় নীরবে মাথা নাড়িল। ব্যোমকেশ যেন তাহা লক্ষ্য না করিয়াই নিজের ডান হাতের নখগুলি নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল,–’দিময়ন্তী দেবী‌, সেদিন আপনাকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম। তখন সব কথা। আপনি বলেননি। এখন বলবেন কি?’

দময়ন্তী ভয়ার্তা চোখ তুলিলেন,–’কি কথা?’

ব্যোমকেশ নির্লিপ্তভাবে বলিল,–’সেদিন আপনি বলেছিলেন দশ বছর আগে আপনাদের বিয়ে হয়েছিল‌, কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি। বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। নিশানাথবাবু আপনার স্বামী নন—‘

মৃত্যুশরাহতের মত দময়ন্তী কাঁদিয়া উঠিলেন,–’না না‌, উনিই আমার স্বামী-উনিই আমার স্বামী-?’ বলিয়া নিজের কোলের উপর ঝুকিয়া পড়িয়া মুখ ঢাকিলেন।

বিজয় গৰ্জিয়া উঠিল,–’ব্যোমকেশবাবু!’

বিজয়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ব্যোমকেশ বলিয়া চলিল,–’আপনার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয় কথায় আমাদের দরকার ছিল না। অন্য সময় হয়তো চুপ করে থাকতাম‌, কিন্তু এখন তো চুপ করে থাকবার উপায় নেই। সব কথাই জানতে হবে—‘

বিজয় বিকৃত স্বরে বলিল,–’আর কী কথা জানতে চান আপনি?’

ব্যোমকেশ চকিতে বিজয়ের পানে চোখ তুলিয়া করাতের মত অমসৃণ কণ্ঠে বলিল,–’আপনাকেও অনেক কৈফিয়ৎ দিতে হবে‌, বিজয়বাবু; অনেক মিছে কথা বলেছেন আপনি। কিন্তু সে পরের কথা। এখন দময়ন্তী দেবীর কাছ থেকে জানতে চাই‌, যে-রাত্রে নিশানাথবাবুর মৃত্যু হয় সে-রত্রে কী ঘটেছিল?’

দময়ন্তী গুমরিয়া গুমরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। বিজয় তাঁহার পাশে নতজানু হইয়া বাষ্পরুদ্ধ স্বরে ডাকিতে লাগিল,–’কাকিমা-কাকিমা–!’

প্রায় দশ মিনিট পরে দময়ন্তী অনেকটা শান্ত হইলেন‌, অশ্রুল্লাবিত মুখ তুলিয়া আঁচলে চোখ মুছিলেন। ব্যোমকেশ শুষ্কস্বরে বলিল,–’সত্য কথা গোপন করার অনেক বিপদ। হয়তো এই সত্য গোপনের ফলেই পানুগোপাল বেচারা মারা গেছে। এর পর আর মিথ্যে কথা বলে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলবেন না।’

দয়মন্তী ভগ্নস্বরে বলিলেন,–’আমি মিথ্যে কথা বলিনি‌, সে-রাত্রির কথা যা জানি সব বলেছি।‘

ব্যোমকেশ বলিল,–’দেখুন‌, কী ভয়ঙ্করভাবে নিশানাথবাবুর মৃত্যু হয়েছিল তা বিজয়বাবু জানেন। আপনি পাশের ঘরে থেকেও কিছু জানতে পারেননি‌, এ অসম্ভব। হয় আপনি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে বাড়িতে ছিলেন না‌, কিংবা আপনার চোখের সামনে নিশানাথবাবুর মৃত্যু হয়েছে।‘

পূর্ণ এক মিনিট ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। তারপর বিজয় ব্যগ্রস্বরে বলিল,–’কাকিমা‌, আর লুকিয়ে রেখে লাভ কি। আমাকে যা বলেছ। এঁদেরও তা বল। হয় তো—’

আরও খানিকক্ষণ মুক থাকিয়া দময়ন্তী অতি অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন,–’আমি বাড়িতে ছিলাম না।‘

‘কোথায় গিয়েছিলেন? কি জন্যে গিয়েছিলেন?’

অতঃপর দময়ন্তী স্বলিতস্বরে এলোমেলোভাবে তাঁহার বাহিরে যাওয়ার ইতিহাস বলিলেন। দীর্ঘ আট মাসের ইতিহাস; তাঁহার ভাষায় বলিলে অনাবশ্যক জটিল ও জবড়জং হইয়া পড়িবে। সংক্ষেপে তাহা এইরূপ–

আট নয় মাস পূর্বে দময়ন্তী ডাকে একটি চিঠি পাইলেন। লাল সিং-এর চিঠি। লাল সিং লিখিয়াছে-জেল হইতে বাহির হইয়া আমি তোমাদের সন্ধান পাইয়াছি। ছদ্মবেশে গোলাপ কলোনী দেখিয়া আসিয়াছি‌, তোমাদের সব কীর্তি জানিতে পারিয়াছি। আমি ভীষণ প্ৰতিহিংসা লইতে পারিতাম। কিন্তু তাহা লইব না। আমার টাকা চাই। কাল রাত্ৰি দশটা হইতে এগারোটার মধ্যে কলোনীর ফটকের পাশে যে কাচের ঘর আছে। সেই ঘরে বেঞ্চির উপর ৫০০ টাকা রাখিয়া আসিবে। কাহাকেও কিছু বলিবে না‌, বলিলে তোমাদের দু’জনকেই খুন করিব। এর পর আমি তোমাকে চিঠি লিখিব না। (জেলে বাংলা শিখিয়াছি কিন্তু লিখিতে চাই না)‌, টাকার দরকার হইলে মোটরের একটি ভাঙা অংশ বাড়ির কাছে ফেলিয়া দিয়া যাইব। তুমি সেই রাত্ৰে নির্দিষ্ট সময়ে ৫০০ টাকা কাচের ঘরে রাখিয়া আসিবো। —

চিঠি পাইয়া দময়ন্তী ভয়ে দিশাহারা হইয়া গেলেন। কিন্তু নিশানাথকে কিছু বলিলেন না। রাত্রে ৫০০ টাকার নোট কাচের ঘরে রাখিয়া আসিলেন। কলোনীর টাকাকড়ি দময়ন্তীর হাতেই থাকিত। কেহ জানিতে পারিল না।

তারপর মাসের পর মাস শোষণ চলিতে লাগিল। মাসে দুই-তিন বার মোটরের ভগ্নাংশ আসে‌, দময়ন্তী কাচের ঘরে টাকা রাখিয়া আসেন। কলোনীর আয় ছিল মাসে প্রায় আড়াই হাজার তিন হাজার‌, কিন্তু এই সময় হইতে আয় কমিতে লাগিল। তাহার উপর এইভাবে দেড় হাজার টাকা বাহির হইয়া যায়। আগে অনেক টাকা উদ্ধৃত্তি হইত‌, এখন টায়ে টায়ে খরচ চলিতে লাগিল।

0 Shares