নিশানাথ টাকার হিসাব রাখিতেন না, কিন্তু তিনিও লক্ষ্য করিলেন। তিনি দময়ন্তীকে প্রশ্ন করিলেন, দময়ন্তী মিথ্যা বলিয়া তাঁহাকে স্তোক দিলেন; আয় কমিয়া যাওয়ার কথা বলিলেন, খরচ বাড়ার কথা বলিলেন না।
এইভাবে আট মাস কাটিয়াছে। নিশানাথের মৃত্যুর দিন সকালে দময়ন্তী আবার একখানি চিঠি পাইলেন। লাল সিং লিখিয়াছে-আমি এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, যাইবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করিয়া যাইতে চাই। তুমি রাত্রি দশটার সময় কাচের ঘরে আসিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিবে। যদি এগারোটার মধ্যে না যাইতে পারি। তখন ফিরিয়া যাইও। আমি তোমাকে ক্ষমা করিয়াছি কিন্তু কাহাকেও কিছু বলিলে কিম্বা আমাকে ধরিবার চেষ্টা করিলে খুন করিব।
সে-রাত্রে আহারের পর বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া দময়ন্তী দেখিলেন, নিশানাথ আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িয়াছেন। দময়ন্তী নিঃশব্দে পিছনের দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেলেন। কিন্তু লাল সিং আসিল না। দময়ন্তী এগারোটা পর্যন্ত কাচের ঘরে অপেক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিলেন। দেখিলেন নিশানাথ পূর্ববৎ ঘুমাইতেছেন। তখন তিনিও নিজের ঘরে গিয়া শয়ন করিলেন।
পরদিন প্ৰাতঃকালে উঠিয়া নিশানাথের গায়ে হাত দিয়া দময়ন্তী দেখিলেন নিশানাথ বাঁচিয়া নাই। তিনি চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন।
ব্যোমকেশ নত মুখে সমস্ত শুনিল, তারপর বিজয়ের দিকে চোখ তুলিয়া বলিল,–’বিজয়বাবু্, আপনি এ কাহিনী কবে জানতে পারলেন?’
বিজয় বলিল,–’তিন-চার দিন আগে। আমি আগে জানতে পারলে–’
ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল,–’অন্য কথাটা অর্থাৎ আপনার কাকার সঙ্গে দময়ন্তী দেবীর প্রকৃত সম্পর্কের কথা। আপনি গোড়া থেকেই জানেন। কোনও সময় কাউকে একথা বলেছেন?’
বিজয় চমকিয়া উঠিল, তাহার মুখ ধীরে ধীরে রক্তাভ হইয়া উঠিল। সে বলিল,–’না, কাউকে না।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বরাটকে বলিল,–’চলুন, এবার যাওয়া যাক।’
দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–’একটা খবর দিয়ে যাই। লাল সিং দু’বছর আগে জেলে মারা গেছে।’
২১
শেষ রাত্রির দিকে কলকাতায় ফিরিয়া পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিতে দেরি হইল। শয্যাত্যাগ করিয়া দেখিলাম আকাশ জলভারাক্রান্তু হইয়া আছে, আজও মেঘ কাটে নাই। বসিবার ঘরে গিয়া দেখি তক্তপোশের উপর ব্যোমকেশ ও আর একজন চায়ের পেয়ালা লইয়া বসিয়াছে। আমার আগমনে লোকটি ঘাড় ফিরাইয়া দন্ত বাহির করিল। দেখিলাম-বিকাশ।
আমিও তক্তপোশে গিয়া বসিলাম। বিকাশের মুখখানা বকাটে ধরনের কিন্তু তাহার দাঁত-খিচানো হাসিতে একটা আপন-করা ভাব আছে। তাহার বাচনভঙ্গীও অত্যন্ত সিধা ও বস্তুনিষ্ঠ। সে বলিল,–’উনিশ নম্বরে গিয়ে জোন কয়লা হয়ে গিয়েছে স্যার।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’কী দেখলেন শুনলেন বলুন।’
বিকাশ সক্ষোভে বলিল,–’কি আর দেখব শুনব স্যার, একেবারে লঝঝড় মাল, নাইনটীন-ফিফটীন মডেল–’
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিল,–’হ্যাঁ হ্যাঁ। বুঝেছি। ওখানে কি কি খবর পেলেন। তাই বলুন।’
বিকাশ বলিল,–’খবর কিসসু নেই। ও বাড়িতে দুটো বস্তাপচা ইস্ত্রীলোক থাকে—‘
‘দুটো!’ বোমকেশের স্বর উত্তেজিত হইয়া উঠিল।
‘আজ্ঞে। বাড়িতে তিনটে ঘর আছে, কিন্তু ইস্ত্রীলোক থাকে দুটোই।’
‘ঠিক দেখেছেন, দুটোর বেশি নেই?’
বিকাশের আত্মসম্মানে আঘাত লাগিল,–’দুটোর জায়গায় যদি আড়াইটে বেরোয় স্যার, আমার কান কেটে নেবেন। অমন ভুল বিকাশ দত্ত করবে না।’
‘না না, আপনি ঠিকই দেখেছেন। কিন্তু তৃতীয় ঘরে কি কেউ থাকে না, ঘরটা খোলা পড়ে থাকে?’
‘খোলা পড়ে থাকবে কেন স্যার, বাড়িওয়ালা ও-ঘরটা নিজের দখলে রেখেছে। মাঝে মাঝে আসে, তখন থাকে।’
‘ও—’ ব্যোমকেশ আবার নিস্তেজ হইয়া পড়িল।
তারপর বিকাশ আরও কয়েকটা খুচরা খবর দিল, কিন্তু তাহা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক এবং ছাপার অযোগ্য বলিয়া উহ্য রাখিলাম।
বিকাশ চলিয়া যাইবার পর প্রায় পনরো মিনিট ব্যোমকেশ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,–’ব্যস, প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। অজিত, তুমি নীচের ডাক্তারখানা থেকে কিছু ব্যান্ডেজ, কিছু তুলো আর একশিশি টিঙ্কার আয়োডিন কিনে আনো দেখি।’
অবাক হইয়া বলিলাম,–’কি হবে ওসব?’
‘দরকার আছে। যাও, আমি ইতিমধ্যে কলোনীতে টেলিফোন করি।–হ্যাঁ, গোটা দুই বেশ পুরু খাম মনিহারী দোকান থেকে কিনে এনো।’ বলিয়া সে টেলিফোন তুলিয়া লইল।
আমি জামা পরিতে পরিতে শুনিলাম সে বলিতেছে-‘হ্যালো…কে, বিজয়বাবু? একবার নেপালবাবুকে ফোনে ডেকে দেবেন? বিশেষ দরকার। …’
সওদা করিয়া ফিরিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ টেলিফোনে বাক্যালাপ শেষ করিয়াছে, টেবিলে ঝুকিয়া বসিয়া দুইটি ফটোগ্রাফ দেখিতেছে।
ফটোগ্রাফ দুইটি সুনয়নার, রমেনবাবু যাহা দিয়াছিলেন। আমাকে দেখিয়া সে বলিল,–’এবার মন দিয়ে শোনো।’–
দু’টি খামে ফটো দুইটি পুরিয়া সযত্নে আঠা জুড়িতে জুড়িতে ব্যোমকেশ বলিল,–’আমি কিছুদিন থেকে একটা দুদন্তি গুণ্ডাকে ধরবার চেষ্টা করছি। গুণ্ডা কাল রাত্রে বাদুড়বাগানের মোড়ে আমাকে ছুরি মেরে পালিয়েছে। আঘাত গুরুতর নয়, কিন্তু গুণ্ডা। আমাকে ছাড়বে না, আবার চেষ্টা করবে। আমি তাকে আগে ধরব, কিম্বা সে আমাকে আগে মারবে, তা বলা যায় না। যদি সে আমাকে মারে তাহলে গোলাপ কলোনীর রহস্যটা রহস্যই থেকে যাবে। তাই আমি এক উপায় বার করেছি। এই দু’টি খামে দু’টি ফটো রেখে যাচ্ছি। একটি খাম নেপালবাবুকে দেব, অন্যটি ভুজঙ্গধরবাবুকে। আমি যদি দু’চার দিনের মধ্যে গুণ্ডার ছুরিতে মারা যাই তাহলে তাঁরা খাম খুলে দেখবেন আমি কাকে কলোনীর হত্যা সম্পর্কে সন্দেহ করি। আর যদি গুণ্ডাকে ধরতে পারি তখন আমার অপঘাত-মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে; তখন আমি খাম দু’টি ওঁদের কাছ থেকে ফেরত নেব এবং গোলাপ কলোনীর অনুসন্ধান যেমন চালাচ্ছি। তেমনি চালাতে থাকব। বুঝতে পারলে?’