চিড়িয়াখানা

‘আমার তো মনে হল মোটরের ব্যাপারটাই প্রধান–তোমার কি অন্যরকম মনে হচ্ছে?’

‘বুঝতে পারছি না। নিশানাথবাবু চাপা স্বভাবের লোক‌, হয়তো আমার কাছেও ওঁর প্রকৃত উদ্বেগের কারণ প্ৰকাশ করতে চান না।’

কথাটা ভাবিয়া দেখিয়া বলিলাম,–’কিন্তু যে-বয়সে মানুষ চিত্রাভিনেত্রীর পশ্চাদ্ধাবন করে ওঁর সে বয়স নয়।’

‘তার চেয়ে বড় কথা‌, ওঁর মনোবৃত্তি সে রকম নয়; নইলে বুড়ো লম্পট আমাদের দেশে দুষ্পপ্ৰাপ্য নয়। ওঁর পরিমার্জিত বাচনভঙ্গী থেকে মনোবৃত্তির যেটুকু ইঙ্গিত পেলাম তাতে মনে হয়। উনি মনুষ্য জাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। ঘৃণাও করেন না; একটু তিক্ত কৌতুকমিশ্রিত অবজ্ঞার ভাব। উচ্ছের সঙ্গে তেঁতুল মেশালে যা হয় তাই।’

উচ্ছে ও তেঁতুলের কথায় মনে পড়িয়া গেল। আজ পুঁটিরামকে উক্ত দুইটি উপকরণ সহযোগে অম্বল রাঁধিবার ফরমাশ দিয়াছি। আমি স্নানাহারের জন্য উঠিয়া পড়িলাম। বলিলাম,–’তুমি এখন কি করবে?’

সে বলিল,–’মোটরের ব্যাপারে চিন্তা ছাড়া কিছু করবার নেই। আপাতত পলাতক অভিনেত্রী সুনয়নার পশ্চাদ্ধাবন করাই প্রধান কাজ।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিল‌, ভাবিতে ভাবিতে বলিল,–’Blackmaid কথাটা সম্বন্ধে নিশানাথবাবুর এত কৌতুহল কেন? বাংলা ভাষায় blackmail-এর প্রতিশব্দ আছে কিনা তা জেনে ওঁর কি লাভ?’

আমি মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে বলিলাম,—’আমার বিশ্বাস ওটা অবচেতন মনের ক্রিয়া। হয়তো লাল সিং জেল থেকে বেরিয়েছে‌, সে-ই মোটরের টুকরো পাঠিয়ে ওঁকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।’

‘লাল সিং যদি জেল থেকে বেরিয়েই থাকে‌, সে নিশানাথবাবুকে blackmaid করবার চেষ্টা করবে। কেন? উনি তো বে-আইনী কিছু করেননি; আসামীকে ফাঁসির হুকুম দেওয়া বে-আইনী কাজ নয়। তবে লাল সিং প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করতে পারে। হয়তো এই বারো বছর ধরে সে রাগ পুষে রেখেছে। কিন্তু নিশানাথবাবুর ভাব দেখে তা মনে হয় না। তিনি যদি লাল সিংকে সন্দেহ করতেন তাহলে অন্তত খোঁজ নিতেন সে জেল থেকে বেরিয়েছে কি না।’

ব্যোমকেশ সিগারেটের দগ্ধাবশেষ ফেলিয়া দিয়া তক্তপোশের উপর চিৎ হইয়া শুইল। নিজ মনেই বলিল,–’নিশানাথবাবুর স্মৃতিশক্তি বোধ হয় খুব প্রখর।’

‘এটা জানলে কি করে?’

‘তিনি হাকিম-জীবনে নিশ্চয় হাজার হাজার ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার করেছেন। সব আসামীর নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি লাল সিংয়ের নাম ঠিক মনে করে রেখেছেন।’

‘লাল সিং তাঁকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল‌, হয়তো সেই কারণেই নামটা মনে আছে।’

‘তা হতে পারে’ বলিয়া সে আবার সিগারেট ধরাইবার উপক্ৰম করিল।

আমি বলিলাম,–’না না‌, আর সিগারেট নয়‌, ওঠে এবার। বেলা একটা বাজে।’

বৈকালে ব্যোমকেশ বলিল,–’তোমাদের লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ সাহিত্যিকেরা তো আজকাল সিনেমার দলে ভিড়ে পড়েছেন। তা তোমার চেনাশোনা কেউ ওদিকে আছেন নাকি?’

অবস্থাগতিকে সাহিত্যিক মহলে আমার বিশেষ মেলামেশা নাই। যাঁহারা উন্নলাট সাহিত্যিক তাঁহারা আমাকে কলকে দেন না‌, কারণ আমি গোয়েন্দা কাহিনী লিখি; আর যাঁহারা সাহিত্য-খ্যাতি অর্জন করিবার পর শিং ভাঙিয়া বাছুরের দলে ঢুকিয়া পড়িয়াছেন তাঁহাদের সহিত ঘনিষ্ঠতা করিবার আগ্রহ আমার নাই। কেবল চিত্র-নাট্যকার ইন্দু রায়ের সহিত সদ্ভাব ছিল। তিনি সিনেমার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিয়াও সহজ মানুষের মত বাক্যালাপ ও আচার-ব্যবহার করিতেন।

ব্যোমকেশকে ইন্দু রায়ের নামোল্লেখ করিলে সে বলিল,–’বেশ তো। ওঁর বোধ হয় টেলিফোন আছে‌, দেখ না। যদি সুনয়নার খবর পাও।’

প্রশ্ন শুনিয়া বলিলেন,–’সুনয়নী! কৈ‌, নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে না তো। আমি অবশ্য ওদের বড় খবর রাখি না।–’

বলিলাম,–’ওদের খবর রাখে এমন কারুর খবর দিতে পারেন?’

ইন্দুবাবু ভাবিয়া বলিলেন,–’এক কাজ করুন। রমেন মল্লিককে চেনেন?’

‘না। কে তিনি? সিনেমার লোক?’

‘সিনেমার লোক নয়। কিন্তু সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়া‌, চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে এমন লোক নেই যার নাড়িনক্ষত্ৰ জানেন না। ঠিকানা দিচ্ছি‌, তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন। অতি অমায়িক লোক‌, তার শিষ্টতায় মুগ্ধ হবেন।’ বলিয়া রমেন মল্লিকের ঠিকানা দিলেন।

সন্ধ্যার পর ব্যোমকেশ ও আমি মল্লিক মহাশয়ের ঠিকানায় উপস্থিত হইলাম। তিনি সাজগোজ করিয়া বাহির হইতেছিলেন‌, আমাদের লইয়া বৈঠকখানায় বসাইলেন। দেখিলাম‌, রমেনবাবু ধনী ও বিনয়ী্‌্‌, তাঁহার বয়স চল্লিশের আশেপাশে‌, হৃষ্টপুষ্ট দীর্ঘ আকৃতি; মুখখানি পেঁপে। ফলের ন্যায় চোয়ালের দিকে ভারি‌, মাথার দিকে সঙ্কীর্ণ; গোঁফজোড়া সূক্ষ্ম ও যত্নলালিত; পরিধানে শৌখিন দেশী বেশ-কোঁচান। কাঁচ ধুতির উপর গিলে-করা স্বচ্ছ পাঞ্জাবি; পায়ে বার্নিশ পাম্প।

ব্যোমকেশের নাম শুনিয়া এবং আমরা ইন্দুবাবুর নির্দেশে আসিয়াছি জানিতে পারিয়া রমেনবাবু যেন স্বৰ্গ হাতে পাইলেন। তৎক্ষণাৎ বরফ দেওয়া ঘোলের সরবৎ ও সন্দেশ আসিয়া উপস্থিত হইল।

আদর-আপ্যায়নের ফাঁকে ব্যোমকেশ কাজের কথা পাড়িল‌, বলিল,–’আপনি শুনলাম চলচ্চিত্রের বিশ্বকোষ‌, সিনেমা জগতে এমন মানুষ নেই। যার নাড়ির খবর জানেন না।’

রমেনবাবু সলজ্জ বিনয়ে বলিলেন,–’ওটা আমার একটা নেশা। কিছু নিয়ে থাকা চাই তো। তা বিশেষ কারুর কথা জানতে চান নাকি?’

‘হ্যাঁ‌, সুনয়না নামে একটি মেয়ে বছর দুই আগে—’

রমেনবাবু চকিত চক্ষে চাহিলেন,–’সুনয়না। মানে-নেত্যকালী?’

‘নেত্যকালী!’ ‘সুনয়নার আসন নাম নৃত্যকালী। তার সম্বন্ধে কোনও নতুন খবর পাওয়া গেছে নাকি?’

0 Shares