বলিলাম,–’কিছু কিছু বুঝেছি। কিন্তু এই অভিনয়ের ফল কি হবে?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’ফল কিছুই হবে কি না এখনও জানি না। মা ফলেষু’। নেপালবাবু বারোটার আগেই আসছেন। তুমি এই বেলা আমার হাতে ব্যাণ্ডেজটা বেঁধে দাও। আর, তোমাকে কি করতে হবে শোনো।’–
আমি তাহার বাঁ হাতের প্রগণ্ডে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতে আরম্ভ করিলাম; টিক্কার আয়োডিনে তুলা ভিজাইয়া বেশ মোটা করিয়া তাগার মত পটি বাঁধিলাম; কমিজের আস্তিনে ব্যান্ডেজ ঢাকা দিয়া একফালি ন্যাকড়া দিয়া হাতটা গলা হইতে ঝুলাইয়া দিলাম। এই সঙ্গে ব্যোমকেশ আমার কর্তব্য সম্বন্ধে আমাকে উপদেশ দিল–
বেলা এগারোটার সময় দ্বারের কড়া নড়িল। আমি দ্বারের কাছে গিয়া সশঙ্ককণ্ঠে বলিলাম,–’কে? আগে নাম বল তবে দোর খুলব।’
ওপার হইতে আওয়াজ আসিল,–’আমি নেপাল গুপ্ত।‘ সন্তর্পণে দ্বার একটু খুলিলাম; নেপালবাবু প্ৰবেশ করিলে আবার হুড়কা লাগাইয়া দিলাম।
নেপালবাবুর মুখ ভয় ও সংশয়ে ব্বিৰ্ণ হইয়া গেল, তিনি বলিয়া উঠিলেন,–’এ কি! মতলব কি আপনাদের?’
ব্যোমকেশ তক্তপোশের উপর বালিসে পিঠি দিয়া অর্ধশয়ান ছিল। ক্ষীণকণ্ঠে বলিল,–’ভয় নেই, নেপালবাবু। এদিকে আসুন, সব বলছি।’
নেপালবাবু দ্বিধাজড়িত পদে ব্যোমকেশের পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ ফ্যাকাসে হাসি হাসিয়া বলিল,–’বসুন। টেলিফোনে সব কথা বলিনি, পাছে জানাজানি হয়। আমাকে গুণ্ডারা ছুরি মেরেছে–কাল্পনিক গুণ্ডার নামে অজস্র মিথ্যা কথা বলিয়া শেষে কহিল,–’আপনিই কলোনীর মধ্যে একমাত্র লোক, যার বুদ্ধির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। যদি আমার ভালমন্দ কিছু হয়, তাই এই খামখানা আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। আমার মৃত্যু-সংবাদ যদি পান, তখন খামখানা খুলে দেখবেন, কার ওপর আমার সন্দেহ বুঝতে পারবেন। তারপর যদি অনুসন্ধান চালান, অপরাধীকে ধরা শক্ত হবে না। আমি পুলিসকে আমার সন্দেহ জানিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু পুলিসের ওপর আমার বিশ্বাস নেই। ওরা সব ভণ্ডুল করে ফেলবে।’
শুনিতে শুনিতে নেপালবাবুর সংশয় শঙ্কা কাটিয়া গিয়াছিল, মুখে সদম্ভ প্রফুল্লতা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। তিনি খামখানা সযত্নে পকেটে রাখিয়া বলিলেন,–’ভাববেন না, যদি আপনি মারা যান, আমি আছি। পুলিসকে দেখিয়ে দেব বৈজ্ঞানিক প্রথায় অনুসন্ধান কাকে বলে।’
দেখা গেল ইতিপূর্বে তিনি যে বিজয়কে আসামী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, তাহা আর তাঁহার মনে নাই। বোধহয় বিজয়ের সহিত একটা বোঝাপড়া হইয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল,–’কিন্তু একটা কথা, আমার মৃত্যু-সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত খাম খুলবেন না। গুণ্ডাটাকে যদি জেলে পুরতে পারি, তাহলে আর আমার প্রাণহানির ভয় থাকবে না; তখন কিন্তু খামখানি যেমন আছে তেমনি অবস্থায় আমাকে ফেরত দিতে হবে।’
নেপালবাবু একটু দুঃখিতভাবে শর্ত স্বীকার করিয়া লইলেন।
তিনি প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল, বলিল,–’অজিত, পুঁটিরামকে বলে দাও এ বেলা কিছু খাব না।’
‘খাবে না কেন?
‘ক্ষিদে নেই।’ বলিয়া সে একটু হাসিল।
আমি বেলা একটা নাগাদ আহারাদি শেষ করিয়া আসিলে ব্যোমকেশ বলিল,–’এবার তুমি টেলিফোন কর।’
আমি কলোনীতে টেলিফোন করিলাম। বিজয় ফোন ধরিল। বলিলাম,–’ভুজঙ্গধরবাবুকে একবারটি ডেকে দেবেন?’ ভুজঙ্গধরবাবু আসিলে বলিলাম,–’ব্যোমকেশ অসুস্থ, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়। আপনি আসতে পারবেন?’
মুহুর্তকাল নীরব থাকিয়া তিনি বলিলেন,–’নিশ্চয়। কখন আসব বলুন।’
‘চারটের সময় এলেই চলবে। কিন্তু কাউকে কোনও কথা বলবেন না। গোপনীয় ব্যাপার।’
‘আচ্ছা।‘
চারটের কিছু আগেই ভুজঙ্গধরবাবু আসিলেন। দ্বারের সম্মুখে আগের মতাই অভিনয় হইল। ভুজঙ্গধরবাবু চমকিত হইলেন, তারপর ব্যোমকেশের আহ্বানে তাহার পাশে গিয়া বসিলেন।
সমস্ত দিনের অনাহারে ব্যোমকেশের মুখ শুষ্ক। সে ভুজঙ্গধরবাবুকে গুণ্ডা কাহিনী শুনাইল। ভুজঙ্গধরবাবু তাহার নাড়ি দেখিলেন, বলিলেন,–’একটু দুর্বল হয়েছেন। ও কিছু নয়।’
ব্যোমকেশ কেন সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে বুঝিলাম। ডাক্তারের চোখে ধরা পড়িতে চায় না।
ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,–’যাক, আসল কথাটা কি বলুন।’ আজ তাঁহার আচার আচরণে চপলতা নাই; একটু গম্ভীর।
ব্যোমকেশ আসল কথা বলিল। ভুজঙ্গধর সমস্ত শুনিয়া এবং খামখানি একটু সন্দিগ্ধভাবে পকেটে রাখিয়া বলিলেন,–’এ সব দিকে আমার মাথা খালে না। যা হোক, যদি আপনার ভালমন্দ কিছু ঘটে-আশা করি সে রকম কিছু ঘটবে না।–তখন যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনি বোধহয় এখনও নিঃসন্দেহ হতে পারেননি, তাই ঝেড়ে কাশছেন না। কেমন?’
ব্যোমকেশ বলিল, —’হ্যাঁ। নিঃসন্দেহ হতে পারলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না, সটান পুলিসকে বলতাম-ঐ তোমার আসামী।’
আরও কিছুক্ষণ কথাবাতার পর চা ও সিগারেট সেবন করিয়া ভুজঙ্গধরবাবু বিদায় লইলেন।
আমি জানালার ধারে দাঁড়াইয়া দেখিলাম, তিনি ট্রাম ধরিয়া শিয়ালদার দিকে চলিয়া গেলেন।
ব্যোমকেশ এবার গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বসিল, বলিল,–’ম্যায় ভুখা ইঁ। —পুঁটিরাম?
২২
পুলিস ভ্যানে ফিরিয়া যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল,–’দময়ন্তী দেবীর কথা সত্যি বলেই মনে হয় নিশানাথবাবুর সন্দেহ হয়েছিল। কেউ দময়ন্তীকে blackmail করছে; তাই যেদিন তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যান সেদিন নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। কথাটা তাঁর মনের মধ্যে ছিল তাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।’