চিড়িয়াখানা

বরাট বলিল,–’এখন কথা হচ্ছে‌, কে blackmaid করছে? নিশ্চয় এমন লোক যে দময়ন্তীর গুপ্তকথা জানে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আমাদের জ্ঞানত তিনজন এই গুপ্তকথা জানে-বিজয়‌, ব্ৰজদাস বাবাজী আর নেপালবাবু। নেপালবাবু জানলে মুকুল জানবে। সব মিলিয়ে চারজন; আরও কেউ কেউ থাকতে পারে‌, যাদের আমরা নাম জানি না। আর কিছু না হোক হত্যার একটা স্পষ্ট পরিষ্কার মোটিভ পাওয়া গেল।’

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’স্পষ্ট পরিষ্কার মোটিভটা কি?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ধরা যাক নেপালবাবু blackmail করছিলেন। আট মাস ধরে তিনি বেশ কিছু দোহন করেছেন‌, আরও অনেক দিন পেন্সন ভোগ করবার ইচ্ছে আছে‌, এমন সময় দেখলেন নিশানাথবাবুর সন্দেহ হয়েছে‌, তিনি আমাকে ডেকে এনেছেন। নেপালবাবুর ভয় হল এমন লাভের ব্যবসাটা বুঝি ফেসে যায়। শুধু তাই নয়‌, তিনি যদি ধরা পড়েন তাহলে ইতিপূর্বে তাঁর কন্যার সাহায্যে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তাও প্রকাশ হয়ে পড়বে‌, তাঁর কন্যাটিও যে চিত্রাভিনেত্রী সুনয়না ওরফে নৃত্যকালী তাও আর গোপন থাকবে না। রমেন মল্লিককে আমাদের সঙ্গে দেখে তাঁর এ রকম সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। তিনি তখন কী করবেন? নিশানাথকে মারতে গেলে সব সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়‌, নিৰ্ভয়ে blackmail চালানো যায়। কিন্তু নিশানাথের মৃত্যুটা স্বাভাবিক হওয়া চাই। সুতরাং নিশানাথ যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে মারা গেলেন। কিন্তু তবু খুঁত রয়ে গেল। পুলিসের যাতায়াত শুরু হল। তার ওপর পানুগোপালটা কিছু দেখে ফেলেছিল। অতএব তাকেও সরানো দরকার হল। মোটামুটি এই মোটিভ।’

বরাট বলিল,–’তাহলে কর্তব্য কি?’

ব্যোমকেশ বলিল, —‘একটা প্ল্যান আমার মাথায় ঘুরছে‌, কিন্তু সে বিষয়ে পরে ব্যবস্থা হবে। আজ রাত্রেই একটা কাজ করা দরকার‌, আবার আমাদের কলোনীতে ফিরে যেতে হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে কলোনীর লোকগুলির ওপর নজর রাখতে হবে।’

‘কী উদ্দেশ্য?’

‘আজ মেঘৈর্মেদুরমম্বরং-অভিসারের উপযুক্ত রাত্রি। দেখতে হবে কেউ কারুর ঘরে যায় কিনা। আপনি রাজী?’

‘নিশ্চয় রাজী। কিন্তু আগে চলুন আমার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবেন।’

বরাটের বাসায় আহার শেষ করিয়া আমরা যখন বাহির হইলাম রাত্রি তখন সওয়া নট। একটু আগে যাওয়া ভাল‌, পালা শেষ হইবার পর প্রেক্ষাগৃহে রাত জাগিয়া বসিয়া থাকার মানে হয় না। বরাট আমাদের জন্য দুইটা বিষতি যোগাড় করিয়া লইল।

কলোনী হইতে আধ মাইল দূরে গাড়ি থামানো হইল। ড্রাইভারকে এইখানে গাড়ি রাখিতে বলিয়া আমরা পদব্রজে অগ্রসর হইলাম; আকাশ তেমনি থমথমে হইয়া আছে‌, প্রত্যাশিত বৃষ্টি নামে নাই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে বটে‌, কিন্তু তাহা অবগুষ্ঠিতা বধূর মুচকি হাসির মত লজ্জিত; তাহার পিছনে গুরু গুরু ডাকও নাই।

কলোনীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম একটিও কুঠিতে আলো জ্বলিতেছে না‌, কেবল ভোজনগৃহে আলো। সকলেই আহার করিতে গিয়াছে। ব্যোমকেশ চুপি চুপি আমাদের নির্দেশ দিল,–’অজিত‌, তুমি বিজয়ের কুঠির আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বোসো‌, বিজয় ছাড়া আর কেউ আসে। কিনা লক্ষ্য করবে। —ইন্সপেক্টর বিরাট‌, আপনি দময়ন্তীর খিড়কি দরজার ওপর নজর রাখবেন।’

‘আর আপনি?’

‘আমি নেপালবাবুর সদর আর অন্দর দুদিকেই চোখ রাখব। একটা করবীর ঝাড় দেখে রেখেছি‌, সেখান থেকে দুদিকেই দৃষ্টি রাখা চলবে।’

বরাট ও বোমকেশের বিষতি-পরা মূর্তি অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। আমি বিজয়ের কুঠির এক কোণে একটা ঝোপের মধ্যে আডডা গাড়িলাম।

পনরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ভোজনকারীরা একে একে ফিরিতে আরম্ভ করিল। প্ৰথমে ডাক্তার ভুজঙ্গাধরের ঘরে আলো জ্বলিয়া উঠিল। তারপর বিজয়ের পায়ের শব্দ শুনিলাম; সে নিজের কুঠিতে প্রবেশ করিয়া আলো জ্বলিল। বনলক্ষ্মীর ঘর অন্ধকার‌, সে বোধহয় এখনও রান্নাঘরে আছে।

বসিয়া বসিয়া দময়ন্তী ও নিশানাথের চিন্তাই মনে আসিল; যে-কঙ্কালটুকু পাইয়াছিলাম তাহাতে কল্পনার রক্ত-মাংস সংযোগ করিয়া মানুষের মত করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলাম। —দময়ন্তী বোধহয় লাল সিং-এর মত দুদন্তি নিষ্ঠুর স্বামীকে ভালবাসিত না‌, কিন্তু স্বামী খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হইলে অশিক্ষিত রমণীর স্বাভাবিক কর্তব্যবোধে বিচারকের করুণা-ভিক্ষা করিতে গিয়াছিল; তারপর বিজয় ও নিশানাথের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল‌, দাম্পত্য জীবনের যে-কোমলতা পায় নাই তাহার। আশায় লুব্ধ হইয়াছিল। নিশানাথও ক্রমশ নিজের বিবেকবুদ্ধির বিরুদ্ধে এই সুন্দরী অনাথার মায়োজালে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার অন্তরে ঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হইয়াছিল‌, বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হইয়া তিনি নীতি লঙঘন করিতে পারেন নাই। চাকরি ছাড়িয়া দিয়া এই একান্ত অপরিচিত স্থানে আসিয়া দময়ন্তীর সহিত বাস করিতেছিলেন। …দোষ কাহার‌, কে কাহাকে অধিক প্রলুব্ধ করিয়াছিল‌, এ প্রশ্নের অবতারণা এখন নিরর্থক; কিন্তু এ জগতে কর্মফলের হাত এড়ানো যায় না‌, বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না। নিশানাথ কঠিন মূল্য দিয়াছেন‌, দময়ন্তীও লজ্জা ভয় ও শোকের মাশুল দিয়া জীবনের ঋণ পরিশোধ করিতেছেন। যে ছিদ্রান্বেষী শক্ৰ তাহাদের দুর্বলতার ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়া কৃমিকীটের ন্যায় আত্মপুষ্টি করিতে চায় সে নিমিত্ত মাত্র। আবার তাহাকেও একদিন মাশুল দিতে হইবে—

বিজয়ের ঘরে আলো নিভিয়া গেল; পাশের কুঠিতে বনলক্ষ্মীর আলো জ্বলিল। কিছুক্ষণ পরে কনলক্ষ্মীর ওপাশের কুঠিতে ভুজঙ্গধরবাবুর সেতার বাজিয়া উঠিল! কী সুর ঠিক জানি না‌, কিন্তু দ্রুত তাহার ছন্দ তাল‌, অসন্দিগ্ধ তাহার ভঙ্গী; যেন বহিঃপ্রকৃতির রসালতায় নূতন উদ্দীপনা প্রয়োগ করিবার প্রয়াস পাইতেছে, বিরহী প্রিয়তমাকে আহ্বান করিতেছে—

0 Shares