চিড়িয়াখানা

কাজর রুচিহর রয়নী বিশালা,

তছুপার অভিসার করু নববালা–

দশ মিনিট পরে সেতার থামিল‌, ভুজঙ্গধরবাবু আলো নিভাইলেন। কয়েক মিনিট পরে কনলক্ষ্মীর আলোও নিভিয়া গেল। সব কুঠিগুলি অন্ধকার।

আপন আপনি নিভৃত কক্ষে ইহারা কি করিতেছে-কী ভাবিতেছে? এই কলোনীর তিমিরাবৃত বুকে কোন মানুষটির মনের মধ্যে কোন চিন্তার ক্রিয়া চলিতেছে? বনলক্ষ্মী এখন তাহার সঙ্কীর্ণ বিছানায় শুইয়া কি ভাবিতেছে? কাহার কথা ভাবিতেছে?-যদি অন্তর্যামী হইতাম..

অলস ও অসংলগ্ন চিন্তায় বোধ করি। ঘন্টাখানেক কাটিয়া গেল। হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিলাম। পায়ের শব্দ। দ্রুত অথচ সতর্ক। আমি যে ঝোপে লুকাইয়া ছিলাম তাহার পাশ দিয়া বিজয়ের কুঠির দিকে যাইতেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখিতে পাইলাম না।

যেখানে লুকাইয়া আছি সেখান হইতে বিজয়ের সদর দরজা দশ-বারো হাত দূরে। শুনিতে পাইলাম খট্‌খট্‌ শব্দে দরজায় টোকা পড়িল; তারপর দ্বার খোলার শব্দ পাইলাম। তারপর নিস্তব্ধ।

এই সময় আকাশের অবগুষ্ঠিতা বধূ একবার মুচকি হাসিল। আর আধ মিনিট আগে হাসিলে বিজয়ের নৈশ অতিথিকে দেখিতে পাইতাম।

পাঁচ মিনিট-দশ মিনিট। কুঠির আরও কাছে গেলে হয়তো কিছু শুনিতে পাইতাম‌, কিন্তু সাহসী হইল না। অন্ধকারে হোঁচটি কিম্বা আছাড় খাইলে নিজেই ধরা পড়িয়া যাইব।

দ্বার খোলার মৃদু শব্দ! আবার আমার পাশ দিয়া অদৃশ্যচারী চলিয়া যাইতেছে। আকাশ-বধূ হাসিল না। কাহাকেও দেখা গেল না‌, কেবল একটা চাপা কান্নার নিগৃহীত আওয়াজ কানে আসিল। কে?–কান্নার শব্দ হইতে চিনিতে পারিলাম না‌, কিন্তু যেই হোক সে স্ত্রীলোক!

তারপর আরও এক ঘন্টা হাত পা শক্ত করিয়া বসিয়া রহিলাম। কিন্তু আর কাহারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আর কতক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইবে ভাবিতেছি‌, কানের কাছে ব্যোমকেশের ফিসফিস্ গলা শুনিলাম—’চলে এস। যা দেখবার দেখা হয়েছে।’

ফটকের বাহিরে আসিয়া দেখিলাম ছায়ামূর্তির মত বরাট দাঁড়াইয়া আছে। তিনজনে ফিরিয়া চলিলাম।

ব্যোমকেশ বলিল,–’কে কি দেখলে বল। —অজিত‌, তুমি?’

আমি যাহা শুনিয়াছিলাম বলিলাম।

ব্যোমকেশ নিজের রিপোর্ট দিল,–’আমি একজনকে নেপালবাবুর খিড়কি দিয়ে বেরুতে শুনেছি। নেপালবাবু নয়‌, কারণ পায়ের শব্দ হাল্কা। পনরো-কুড়ি মিনিট পরে তাকে আবার ফিরে আসতে শুনেছি।–ইন্সপেক্টর বিরাট‌, আপনি?’

বরাট বলিল,–’আমি দময়ন্তীর বাড়ি থেকে কাউকে বেরুতে শুনিনি। কিন্তু অন্য কিছু দেখেছি!’

‘কী?’

‘বনলক্ষ্মীকে তার ঘর থেকে বেরুতে দেখেছি। আমি ছিলাম দময়ন্তীর বাড়ির পিছনের কোণে; বনলক্ষ্মীর ঘরের আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর আলো নিভে গেল‌, আমি সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম। একবার একটু বিদ্যুৎ চমকালো। দেখলাম বনলক্ষ্মী নিজের কুঠি থেকে বেরুচ্ছে।’

‘কোন দিকে গেল?’

‘তা জানি না। আর বিদ্যুৎ চমকায়নি।’

কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,–’মুস্কিল মিঞার বৌ মিথ্যা বলেনি। এখন কথা হচ্ছে‌, বিজয়ের ঘরে যে গিয়েছিল সে কে? মুকুল‌, না বনলক্ষ্মী? যদি বনলক্ষ্মী বিজয়ের ঘরে গিয়ে থাকে। তবে মুকুল কোথায় গিয়েছিল?’

২৩

ভুজঙ্গধরবাবু চলিয়া যাইবার ঘণ্টাখানেক পরে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। প্রথমে রিমঝিম তারপর ঝমঝম। দীর্ঘ আয়োজনের পর বেশ জুত করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে‌, শীঘ্ৰ থামিবে বলিয়া বোধ হয় না।

ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী হইতে অনুমান হইল‌, তাহার উদ্যোগ আয়োজনও চরম পরিণতির মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছে‌, ক্রমাগত সিগারেট টানিতেছে। এ সব লক্ষণ আমি চিনি। জাল গুটিাইয়া আসিতেছে।

মেঘের অন্তরপথে দিন শেষ হইয়া রাত্রি আসিল। আটটার সময় ব্যোমকেশ প্রমোদ বরািটকে ফোন করিল; অনেকক্ষণ ধরিয়া ফোনের মধ্যে গুজগুজ করিল। তাহার সংলাপের ছিন্নাংশ হইতে এইটুকু শুধু বুঝিলাম যে‌, গোলাপ কলোনীর উপর কড়া পাহারা রাখা দরকার‌, কেহ না পালায়।

রাত্রে ঘুমের মধ্যেও অনুভব করিলাম‌, ব্যোমকেশ জাগিয়া আছে এবং বাড়িময় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছে।

সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি হইল। সকালে দেখিলাম‌, মেঘগুলো ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে; বৃষ্টির তেজ কমিয়াছে কিন্তু থামে নাই। এগারেটার সময় বৃষ্টি বন্ধ হইয়া পাঙাস সূৰ্য্যলোক দেখা দিল।

ব্যোমকেশ ছাতা লইয়া গুটি গুটি বাহির হইতেছে দেখিয়া বলিলাম,–’এ কি! চললে কোথায়?’

উত্তর না দিয়া সে বাহির হইয়া গেল। ফিরিল বিকাল সাড়ে তিনটার সময়। জিজ্ঞাসা করিলাম,–’আজও কি একাদশী?’

সে বলিল,–’উহুঁ‌, কাফে সাজাহানে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে দিব্যি চৰ্ব-চোষ্য হয়েছে।’

‘যদি নেপাল গুপ্ত কিম্বা ভূজঙ্গ ডাক্তার দেখে ফেলত!’

‘সে সম্ভাবনা কম। তাঁরা কেউ কলোনী থেকে বেরুবার চেষ্টা করলে গ্রেপ্তার হতেন।’

‘যাক‌, ওদিকে তাহলে পাকা বন্দোবস্ত করেছ। এদিকের খবর কি‌, গিছলে কোথায়?’

‘প্রথমত কপোরেশন অফিস। ১৯ নং মিজা লেন বাড়িটির মালিক কে জািনবার কৌতুহল হয়েছিল।’

‘মালিক কে-ভুজঙ্গধরবাবু?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল,–’না‌, একজন স্ত্রীলোক।’

‘আর কোথায় গিছলে?’

‘রমেনবাবুর কাছে। সুনয়নার আরও দুটো ফটো যোগাড় করেছি।’

‘আর কি করলে?’

‘আর‌, একবার চীনেপটিতে গিয়েছিলাম দাঁতের সন্ধানে।’

‘দাঁতের সন্ধানে?’

‘হ্যাঁ। চীনেরা খুব ভাল দাঁতের ডাক্তার হয় জানো? বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সে স্নান-ঘরের দিকে চলিয়া গেল! আমি বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম-নাটকের পঞ্চম অঙ্কে যবনিকা পড়িতে আর দেরি নাই‌, অথচ নাটকের নায়ক-নায়িকাকে চিনিতে পারিতেছি না কেন?

0 Shares