চিড়িয়াখানা

তারপর দ্বিধাভরে বলিল,–’আছে। কিন্তু—‘

ব্যোমকেশের মুখে চোখে উত্তেজনা ফাটিয়া পড়িতেছিল‌, সে একটু শান্ত হইবার চেষ্টা করিয়া বলিল,–’আপনার ‘কিন্তু’র জবাব আমি দিতে পারব না‌, কিন্তু আমার বিশ্বাস বাঘ এবং বাঘিনীকে এক জায়গাতেই পাওয়া যাবে।–চলুন আর দেরি নয়‌, খাতপত্র নিয়ে নিন। আপনাদের বিশেষজ্ঞদের অফিস বোধহয় কলকাতায়?’

‘হ্যাঁ। চলুন।’

বিশেষজ্ঞ মহাশয়ের মন্তব্য লইয়া আমরা যখন বাহির হইলাম তখন বেলা দুটা বাজিয়া গিয়াছে। ক্ষুধাতৃষ্ণার কথা কাহারও মনে ছিল না; ব্যোমকেশ বরাটের পিঠ চাপড়াইয়া বলিল,–’আসুন‌, আমাদের বাসাতেই শাক-ভাত খাবেন।’

বরাট বলিল,–’কিন্তু–ও কাজটা যে এখনও বাকী-?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ও কাজটা পরে হবে। আগে খাওয়া‌, তারপর খানাতল্লাস–তারপর আবার গোলাপ কলোনী। গোলাপ কলোনীর বিয়োগাদ্য নাটকে আজই যবনিক পতন হবে।’

গোলাপ কলোনীতে নিশানাথবাবুর বহিঃকক্ষে সভা বসিয়াছিল। ঘরের মধ্যে ছিলাম আমরা তিনজন এবং দময়ন্তী দেবী ছাড়া কলোনীর সকলে। রসিক দে’কেও হাজত হইতে আনা হইয়াছিল। দময়ন্তী দেবীর প্রবল মাথা ধরিয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে সভার অধিবেশন হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া হইয়াছিল। দুইজন সশস্ত্ৰ পুলিস কর্মচারী দ্বারের কাছে পাহারা দিতেছিল।

রাত্ৰি প্ৰায় আটটা। মাথার উপর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছিল। সামনের দেয়ালে নিশানাথবাবুর একটি বিশদীকৃত ফটোগ্রাফ টাঙানো হইয়াছিল। নিশানাথের ঠোঁটের কোণে একটু নৈর্ব্যক্তিক হাসি‌, তিনি যেন হাকিমের উচ্চ আসনে বসিয়া নিরাসক্তভাবে বিচার-সভার কার্যবিধি পরিচালনা করিতেছেন।

ব্যোমকেশের মুখে আতপ্ত চাপা উত্তেজনা। সে একে একে সকলের মুখের উপর চোখ কুলাইয়া ধীরকষ্ঠে বলিল,–’আপনারা শুনে সুখী হবেন নিশানাথবাবু এবং পানুগোপালকে কারা হত্যা করেছিল তা আমরা জানতে পেরেছি।’

কেহ কথা কহিল না। নেপালবাবু ফস করিয়া দেশলাই জ্বালাইয়া নিবপিত চুরুট ধরাইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,–’শুধু যে জানতে পেরেছি তা নয়‌, অকাট্য প্রমাণও পেয়েছি। অপরাধীরা এই ঘরেই আছে। অন্নদাতা নিশানাথবাবুকে যারা বীভৎসভাবে হত্যা করেছে‌, অসহায় নিরীহ পানুগোপালকে যারা বিষ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে‌, আইন তাদের ক্ষমা করবে না। তাদের প্ৰাণদণ্ড নিশ্চিত। তাই আমি আহ্বান করছি‌, মনুষ্যত্বের কণামাত্র যদি অপরাধীদের প্রাণে থাকে তারা অপরাধ স্বীকার করুক।’

এবারও সকলে নীরব। ভুজঙ্গধরবাবুর মুখের মধ্যে যেন সুপারি-লিবঙ্গের মত একটা কিছু ছিল‌, তিনি সেটা এ গাল হইতে ও গালে লইলেন। বিজয় একদৃষ্টি ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল। মুকুলকে দেখিয়া মনে হয়‌, সে যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়াছে। আজ তাহার মুখে রুজ পাউডার নাই; রক্তহীন সুন্দর মুখে অজানিতের বিভীষিকা।

ঘরের অন্য কোণে বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া বসিয়া আছে‌, কিন্তু তাহার মুখে প্রবল উদ্বেগের ব্যঞ্জনা নাই। সে কোলের উপর হাত রাখিয়া আঙুলগুলা লইয়া খেলা করিতেছে‌, যেন অদৃশ্য কাঁটা দিয়া অদৃশ্য পশমের জামা বুনিতেছে।

আধ মিনিট পরে ব্যোমকেশ বলিল, —’বেশ‌, তাহলে আমিই বলছি। —নেপালবাবু্‌, আপনি নিশানাথবাবুর সম্বন্ধে একটা গুপ্তকথা জানেন। আমি যখন জানতে চেয়েছিলাম। তখন আপনি অস্বীকার করেছিলেন কেন?’

নেপালবাবুর চোখের মধ্যে চকিত আশঙ্কার ছায়া পড়িল‌, তিনি স্খলিতস্বরে বলিলেন,–’আমি-আমি-’

ব্যোমকেশ বলিল,–’যাক‌, কেন অস্বীকার করেছিলেন তার কৈফিয়ৎ দরকার নেই। কিন্তু কার কাছে এই গুপ্তকথা শুনেছিলেন? কে আপনাকে বলেছিল?—আপনার মেয়ে মুকুল?’ ব্যোমকেশের তর্জনী মুকুলের দিকে নির্দিষ্ট হইল।

নেপালবাবু ঘোর শব্দ করিয়া গলা পরিষ্কার করিলেন। বলিলেন,–’হ্যাঁ-মানে—মুকুল জানতে পেরেছিল–’

ব্যোমকেশ বলিল,–’কার কাছে জানতে পেরেছিল?–আপনার কাছে?’ ব্যোমকেশের তর্জনী দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটার মত বিজয়ের দিকে ফিরিল।

বিজয়ের মুখ সাদা হইয়া গেল‌, সে মুখ তুলিতে পারিল না। অধোমুখে বলিল,–’হ্যাঁ-আমি বলেছিলাম। কিন্তু–’

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করিল,–’আর কাউকে বলেছিলেন?’ বিজয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটিয়া উঠিল। সে ব্যাকুল চোখ তুলিয়া চারিদিকে চাহিল‌, তারপর আবার অধোবাদন হইল। উত্তর দিল না।

ব্যোমকেশ বলিল,–’যাক‌, আর একটা কথা বলুন। আপনি দোকান থেকে যে টাকা সরিয়েছিলেন সে টাকা কার কাছে রেখেছেন?’

বিজয় হেঁট মুখে নিরুত্তর রহিল।

‘বলবেন না?’ ব্যোমকেশ ঘরের অন্যদিকে যেখানে রসিক দে বৃষিকাষ্ঠের মত শক্ত হইয়া বসিয়াছিল। সেইদিকে ফিরিল, —’রসিকবাবু্‌, আপনিও দোকানের টাকা চুরি করে একজনের কাছে রেখেছিলেন‌, তার নাম বলবেন না?’

রসিকের কণ্ঠের হাড় একবার লাফাইয়া উঠিল‌, কিন্তু সে নীরব রহিল; আঙুলকাটা হাতটা একবার চোখের উপর বুলাইল।

ব্যোমকেশের অধরে শুষ্ক ব্যঙ্গ ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল,–’ধন্য আপনারা! ধন্য আপনাদের একনিষ্ঠা! কিন্তু একটা কথা বোধহয় আপনারা জানেন না। বিজয়বাবু্‌, আপনি যার কাছে টাকা জমা রাখছেন‌, রসিকবাবুও ঠিক তার কাছেই টাকা গচ্ছিত রাখছিলেন। এবং দু’জনেই আশা করেছিলেন যে‌, একদিন শুভ মুহুর্তে বামাল সমেত গোলাপ কলোনী থেকে অদৃশ্য হয়ে কোথাও এক নিভৃত স্থানে রোমান্সের নন্দন-কানন রচনা করবেন। বলিহারি!’

রসিক এবং বিজয় দু’জনেই একদৃষ্টি একজনের দিকে তাকাইয়া একসঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল।

0 Shares