চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল,–’বসুন‌, বসুন‌, আমি যা জানতে চাই তা জানতে পেরেছি‌, আর আপনাদের কিছু বলবার দরকার নেই।–ইন্সপেক্টর বিরাট‌, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আপনি বনলক্ষ্মী দেবীর বাঁ হাতের আঙুলগুলো একবার পরীক্ষা করে দেখুন।’

বরাট উঠিয়া গিয়া বনলক্ষ্মীর সম্মুখে দাঁড়াইল। বনলক্ষ্মী ক্ষণেক ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিয়া বাঁ হাতখানা সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিল।

ভুজঙ্গধরবাবু এইবার কথা কহিলেন। একটু জড়াইয়া জড়াইয়া বলিলেন,–’কী ধরনের অভিনয় হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না-নাটক‌, না প্ৰহসন‌, না কমিক অপেরা!’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূর্বেই বরাট বলিল,–’এঁর তর্জনীর আগায় কড়া পড়েছে‌, মনে হয় ইনি তারের যন্ত্র বাজাতে জানেন।’

বরাট স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। ভুজঙ্গধরবাবু অস্ফুটম্বরে বলিলেন,–’তাহলে কমিক অপেরা!’

ব্যোমকেশ ভুজঙ্গধরবাবুকে হিম-কঠিন দৃষ্টি দ্বারা বিদ্ধ করিয়া বলিল,–’এটা কমিক অপেরা নয় তা আপনি ভাল করেই জানেন; আপনি নিপুণ যন্ত্রী, সুদক্ষ অভিনেতা। —কিন্তু আপাতত আর্ট ছেড়ে বৈষয়িক প্রসঙ্গে আসা যাক। ভুজঙ্গধরবাবু্‌, ১৯ নম্বর মির্জা লেনের বাড়িটা বোধহয় আপনার‌, কারণ আপনি ভাড়া আদায় করেন। কেমন?’

ভুজঙ্গাধর স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার গলার একটা শির দপদপ করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ পুনশ্চ বলিল,–’কিন্তু কর্পোরেশনের খাতায় দেখলাম বাড়িটা শ্ৰীমতী নৃত্যকালী দাসের নামে রয়েছে। নৃত্যকালী দাস কি আপনার স্ত্রীর নাম?’

ভুজঙ্গধরবাবুর মুখের উপর দিয়া যেন একটা রোমাঞ্চকর নাটকের অভিনয় হইয়া গেল; মানুষের অন্তরে যতপ্রকার আবেগ উৎপন্ন হইতে পারে‌, সবগুলি দ্রুত পরম্পরায় তাঁহার মুখে প্রতিফলিত হইল। তারপর তিনি আত্মস্থ হইলেন। সহজ স্বরে বলিলেন,–’হ্যাঁ‌, নৃত্যকালী আমার স্ত্রীর নাম‌, ১৯ নম্বর বাড়িটা আমার স্ত্রীর নামে।’

‘কিন্তু–কিয়েকদিন আগে আপনি বলেছিলেন‌, বিলেতে থাকা কালে আপনি এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন।’

‘হ্যাঁ। তাঁরই স্বদেশী নাম নৃত্যকালী-বিলিতি নাম ছিল নিটা।’

‘ও।–নিটা-নৃত্যকালী-সুনয়না‌, আপনার স্ত্রীর দেখছি অনেক নাম। তা–তিনি এখন বিলোতে আছেন?’

‘হ্যাঁ।–যদি না জার্মান বোমায় মারা গিয়ে থাকেন।’

ব্যোমকেশ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল,–’তিনি মারা যাননি। তিনি বিলিতি মেয়ে নন‌, খাঁটি দেশী মেয়ে; যদিও আপনাদের বিয়ে বিলেতেই হয়েছিল। আপনার স্ত্রী এই দেশেই আছেন‌, এমনকি এই ঘরেই আছেন।’

‘ভারি ‘আশ্চর্য কথা।’

‘ভুজঙ্গধরবাবু্‌, আর অভিনয় করে লাভ কি? আপনারা দু’জনেই উঁচুদরের আর্টিস্ট‌, আপনাদের অভিনয়ে এতটুকু খুঁত নেই। কিন্তু অভিনয় যতাই উচ্চাঙ্গের হোক‌, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। অসতর্ক মুহুর্তে আপনি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।’

‘ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। বুঝলাম না।’

‘আপনি বুদ্ধিমান‌, কিন্তু ভয় পেয়ে একটু নিবুদ্ধিতা করে ফেলেছেন। খামটা আপনার খোলা উচিত হয়নি। খামের মধ্যে যে ছবিটা ছিল‌, সেটা আপনি নিজে দেখেছেন‌, স্ত্রীকেও দেখিয়েছেন‌, ছবির ওপর আপনাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। নৃত্যকালী ওরফে সুনয়না ওরফে বনলক্ষ্মী যে আপনার সহধর্মিণী এবং সহকর্মিণী তাতে বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ নেই।’

ভুজঙ্গাধর চকিত বিস্ফারিত চক্ষে বনলক্ষ্মীর পানে চাহিলেন‌, বনলক্ষ্মীও বিস্ময়ে তাঁহার দৃষ্টি ফিরাইয়া দিল। ভুজঙ্গধর মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনার হাসির অর্থ সুনয়নার সঙ্গে বনলক্ষ্মীর চেহারার একটুও মিল নেই‌, এই তো? কিন্তু যে-কথাটা সকলে ভুলে গেছে। আমি তা ভুলিনি‌, ডাক্তার দাস। আপনি বিলেতে গিয়ে প্ল্যাস্টিক সাজারি শিখেছিলেন। এবং বনলক্ষ্মীর মুখের ওপর শিল্পীর হাতের যে অস্ত্ৰোপচার হয়েছে একটু ভাল করে পরীক্ষা করলেই তা ধরা পড়বে। এবং তাঁর সব দাঁতগুলিও যে নিজস্ব নয়‌, তাও বেশি পরীক্ষার অপেক্ষা রাখে না।’

বনলক্ষ্মীর মুখ-ভাবের কোনও পরিবর্তন হইল না‌, বিস্ময়বিমূঢ় ফ্যালফেলে মুখ লইয়া সে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। ভুজঙ্গধর কয়েক মুহুর্ত নতনেত্ৰে চাহিয়া যখন চোখ তুলিলেন‌, তখন মনে হইল অপরিসীম ক্লান্তিতে তাঁহার মন ভরিয়া গিয়াছে। তবু তিনি শান্ত স্বরেই বলিলেন,–’যদি ধরে নেওয়া যায় যে বনলক্ষ্মী আমার স্ত্রী‌, তাতে কী প্ৰমাণ হয়? আমি নিশানাথবাবুকে খুন করেছি। প্রমাণ হয় কি? যে-সময় নিশানাথবাবুর মৃত্যু হয়‌, সে-সময় আমি নিজের বারান্দায় বসে সেতার বাজাচ্ছিলাম। তার সাক্ষী আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনি যে অ্যালিবাই তৈরি করেছিলেন‌, তা সত্যিই অদ্ভুত‌, কিন্তু ধোপে টিকলো না। সে-রত্রে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে আপনি মিনিট পাঁচেক সেতার বাজিয়েছিলেন বটে‌, কিন্তু বাকী সময়টা বাজিয়েছিলেন আপনার স্ত্রী। বনলক্ষ্মী দেবী অস্বীকার করলেও তিনি সেতার বাজাতে জানেন‌, তাঁর আঙুলে কড়া আছে।’

‘এটা কি প্ৰমাণ? না জোড়াতাড়িা দেওয়া একটা থিওরি’

‘বেশ‌, এটা থিওরি। আপনি নিশানাথবাবুকে খুন করেছেন এটা যদি আদালতে প্রমাণ নাও হয়‌, তবু আপনাদের নিস্কৃতি নেই ডাক্তার। আপনার ১৯ নম্বর মিজ লেনের বাড়ি আজ বিকেলে পুলিস খানাতল্লাস করেছে; আপনার বন্ধ ঘরটিতে কি কি আছে আমরা জানতে পেরেছি। আছে একটি অপারেটিং টেবিল এবং একটি স্টিলের আলমারি। আলমারিও আমরা খুলে দেখেছি। তার মধ্যে পাওয়া গেছে।-অপারেশনের অস্ত্রশস্ত্ৰ‌, আপনাদের বিয়ের সাটিফিকেট‌, আন্দাজ বিশ হাজার টাকার নেট‌, তামাক থেকে নিকোটিন চোলাই করবার যন্ত্রপাতি‌, আর–’

0 Shares