চিড়িয়াখানা

‘আর–?’

‘মনে করতে পারছেন না? আলমারির চোরা-কুঠুরির মধ্যে যে হীরের নেকলেসটি রেখেছিলেন তার কথা ভুলে গেছেন? মুরারি দত্তর মৃত্যুর সময় ওই নেকলেসটা দোকান থেকে লোপাট হয়ে যায়।–নিশানাথ এবং পানুকে খুন করার অপরাধে যদি বা নিষ্কৃতি পান‌, মুরারি দত্তকে বিষ খাওয়াবার দায় থেকে উদ্ধার পাবেন কি করে?’

ভুজঙ্গধরবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বরাট রিভলবার বাহির করিল। কিন্তু রিভলবার দরকার হইল না। ভুজঙ্গাধর বনলক্ষ্মীর কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর যে অভিনয় হইল। তাহা বাংলা দেশের মঞ্চাভিনয় নয়‌, হলিউডের সিনেমা। বনলক্ষ্মী উঠিয়া ভুজঙ্গাধরের কণ্ঠালগ্ন হইল। ভুজঙ্গাধর তাহাকে বিপুল আবেগে জড়াইয়া লইয়া তাহার উন্মুক্ত অধরে দীর্ঘ চুম্বন করিলেন। তারপর তাহার মুখখানি দুই হাতের মধ্যে লইয়া স্নেহক্ষরিত স্বরে বলিলেন,–’চল‌, এবার যাওয়া যাক।’

মৃত্যু আসিল অকস্মাৎ বজ্ৰপাতের মত। দু’জনের মুখের মধ্যে কাচ চিবানোর মত একটা শব্দ হইল; দু’জনে একসঙ্গে পড়িয়া গেল। যেখানে দেয়ালের গায়ে নিশানাথের ছবি বুলিতেছিল‌, তাহারই পদমূলে ভু-লুষ্ঠিত হইল।

আমরা ছুটিয়া গিয়া যখন তাহাদের পাশে উপস্থিত হইলাম‌, তখন তাঁহাদের দেহে প্ৰাণ নাই‌, কেবল মুখের কাছে একটু মৃদু বাদাম-তেলের গন্ধ লাগিয়া আছে।

বিজয় দাঁড়াইয়া দুঃস্বপ্নভরা চোখে চাহিয়া ছিল। তাহার চোয়ালের হাড় রোমন্থনের ভঙ্গীতে ধীরে ধীরে নড়িতেছিল। মুকুল তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল‌, চাপা গলায় বলিল,–’এস–চলে এস এখান থেকে–’

বিজয় দাঁড়াইয়া রহিল‌, বোধহয় শুনিতে পাইল না। মুকুল তখন তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া ভিতরে লইয়া গেল।

২৫

পরদিন সকালবেলা হ্যারিসন রোডের বাসায় বসিয়া ব্যোমকেশ গভীর মনঃসংযোগে হিসাব কষিতেছিল। হিসাব শেষ হইলে সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিল,—‘জমা ষাট টাকা, খরচ উনষাট টাকা সাড়ে ছয় আনা। নিশানাথবাবু খরচ বাবদ যে ষাট টাকা দিয়েছিলেন, তা থেকে সাড়ে নয় আনা বেঁচেছে!—যথেষ্ট, কি বল?’

আমি নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,—’সত্যান্বেষণের ব্যবসা যে রকম লাভের ব্যবসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত আমাকেও গোলাপ কলোনীতে ঢুকে পড়তে হবে দেখছি।’

বলিলাম,-’ছাগল চরানোর প্রস্তাবটা ভুলো না।’

সে বলিল,-’খুব মনে করিয়ে দিয়েছ। ছাগলের ব্যবসায় পয়সা আছে। একটা ছাগলের ফার্মা খোলা যাক, নাম দেওয়া যাবে—ছাগল কলোনী। কেমন হবে?’

‘চমৎকার। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই।’

‘নেই কেন? বিদ্যাসাগর মশাই থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যে-কাজ করতে পারেন, সে-কাজ তুমি পারবে না! তোমার এত গুমর কিসের?’

বিপজ্জনক প্রসঙ্গ এড়াইয়া গিয়া বলিলাম,-’ব্যোমকেশ, কাল সমস্ত রাত কেবল স্বপ্ন দেখেছি।’

সে চকিত হইয়া বলিল,-’কি স্বপ্ন দেখলে?’

‘দেখলাম বনলক্ষ্মী দাঁত বার করে হাসছে। যতবার দেখলাম, ঐ এক স্বপ্ন।’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,-’অজিত, মনে আছে আর একবার বনলক্ষ্মীকে স্বপ্ন দেখেছিলে। আমি সত্যবতীকে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু আসলে একই কথা। মনস্তত্ত্বের নিগুঢ় কথা। বনলক্ষ্মীর দাঁত যে বাঁধানো তা আমাদের চর্মচক্ষে ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু আমাদের অবচেতন মন জানতে পেরেছিল—তাই বারবার স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের জানাবার চেষ্টা করেছিল। এখন আমরা জানি বনলক্ষ্মীর ওপর পাটির দু’পাশের দুটি দাঁত বাঁধানো, তাতে তার মুখের গড়ন হাসি সব বদলে গেছে। সেদিন ভুজঙ্গাধর ‘দন্তরুচি কৌমুদী’ বলেছিলেন তার ইঙ্গিত তখন হৃদয়ঙ্গম হয়নি।’

‘দন্তরুচির মধ্যে ইঙ্গিত ছিল নাকি?’

‘তা এখনও বোঝোনি? সেদিন সকলের সাক্ষী নেওয়া হচ্ছিল। বাইরের ঘরে বনলক্ষ্মী জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। যেই তার সাক্ষী দেবার ডাক পড়ল ঠিক সেই সময় ভুজঙ্গধরবাবু ঘরে ঢুকলেন। বনলক্ষ্মীকে এক নজর দেখেই বুঝলেন সে তাড়াতাড়িতে দাঁত পরে আসতে ভুলে গেছে। যারা বাঁধানো দাঁত পরে, তাদের এরকম ভুল মাঝে মাঝে হয়। ভুজঙ্গধরবাবু দেখলেন,-সর্বনাশ। বনলক্ষ্মী যদি বিরল-দস্ত অবস্থায় আমার সামনে আসে, তখনি আমার সন্দেহ হবে! তিনি ইশারা দিলেন—দন্তরূচি কৌমুদী। বনলক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পারল এবং তৎক্ষণাৎ নিজের কপালে চুড়ি-সুদ্ধ হাত ঠুকে দিলে। কাচের চুড়ি ভেঙে কপাল কেটে গেল, বনলক্ষ্মী অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বনলক্ষ্মীকে তুলে নিয়ে ভুজঙ্গাধর তার কুঠিতে চললেন। বিজয় যখন তার সঙ্গ নিলে তখন তিনি তাকে বললেন-ডাক্তারখানা থেকে টিথঞ্চার আয়ােডিন ইত্যাদি নিয়ে আসতে। যতক্ষণে বিজয় টিঙ্কার আয়ােডিন নিয়ে বনলক্ষ্মীর ঘরে গিয়ে পৌঁছল, ততক্ষণ বনলক্ষ্মী দাঁত পরে নিয়েছে।’ —

দ্বারে টোকা পড়িল।

ইন্সপেক্টর বরাট এবং বিজয়। বিজয়ের ভাবভঙ্গী ভিজা বিড়ালের মত। বরাট চেয়ারে বসিয়া দুই পা সম্মুখে ছড়াইয়া দিয়া বলিল,-’ব্যোমকেশবাবু, চা খাওয়ান। কাল সমস্ত রাত ঘুমুতে পারিনি। তার ওপর সকাল হতে না হতে বিজয়বাবু এসে উপস্থিত, উনিও ঘুমোননি।’

পুঁটিরামকে চায়ের হুকুম দেওয়া হইল। বরাট বলিল,–’ব্যাপারটা সবই জানি‌, তবু মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে ফাঁক রয়েছে। আপনি বলুন–আমরা শুনব।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’বিজয়বাবু্‌, আপনিও শুনবেন? গল্পটা আপনার পক্ষে খুব গৌরবজনক নয়।‘

বিজয় ম্রিয়মাণ স্বরে বলিল,–’শুনব।’

‘বেশ‌, তাহলে বলছি।’ অতিথিদের সিগারেটের টিন বাড়াইয়া দিয়া ব্যোমকেশ আরম্ভ করিল,–’যা বলব তাকে আপনারা গল্প বলেই মনে করবেন‌, কারণ তার মধ্যে খানিকটা অনুমান‌, খানিকটা কল্পনা আছে। গল্পের নায়ক নায়িকা অবশ্য ভুজঙ্গাধর ডাক্তার আর নৃত্যকালী।

0 Shares