চিড়িয়াখানা

‘ভুজঙ্গধর আর নৃত্যকালী স্বামী-স্ত্রী। বাঘ আর বাঘিনী যেমন পরস্পরকে ভালবাসে‌, কিন্তু বনের অন্য জন্তুদের ভালবাসে না‌, ওরাও ছিল তেমনি সমাজবিরোধী‌, জন্মদুষ্ট অপরাধী। পরম্পরের মধ্যে ওরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ আদর্শের সন্ধান পেয়েছিল। ওদের ভালবাসা ছিল যেমন গাঢ় তেমনি তীব্র। বাঘ আর বাঘিনীর ভালবাসা।

‘লন্ডনের একটি রেজিষ্টি অফিসে ওদের বিয়ে হয়। ডাক্তার তখন প্ল্যাস্টিক সাজারি শিখতে বিলেত গিয়েছিল‌, নৃত্যকালী বোধহয় গিয়েছিল কোনও নৃত্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে। দু’জনের দেখা হল‌, রতনে রতন চিনে নিলে। ওদের প্রেমের মূল ভিত্তি বোধহয় ওদের অভিনয় এবং সঙ্গীতের প্রতিভা। দু’জনেই অসামান্য আর্টিস্ট; সেতারে এমন হাত পাকিয়েছিল যে বাজনা শুনে ধরা যেত না কে বাজাচ্ছে‌, বড় বড় সমজদারেরা ধরতে পারত না।

‘দু’জনে মিলে ওরা কত নীতিগৰ্হিত কাজ করেছিল তার হিসেব আমার জানা নেই-স্টিলের আলমারিতে যে ডায়েরিগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো ভাল করে পড়লে হয়তো সন্ধান পাওয়া যাবে-কিন্তু ডাক্তারের বৈধ এবং অবৈধ ডাক্তারি থেকে বেশ আয় হচ্ছিল; অন্তত উনিশ নম্বর বাড়িটা কেনবার মত টাকা তারা সংগ্রহ করেছিল।

‘কিন্তু ও-ধাতুর লোক অল্পে সন্তুষ্ট থাকে না‌, অপরাধ করার দিকে ওদের একটা অহেতুক প্রবণতা আছে। বছর চারেক আগে ডাক্তার ধরা পড়ল‌, তার নাম কাটা গেল। ডাক্তার কলকাতার পরিচিত পারিবেশ থেকে ডুব মেরে গোলাপ কলোনীতে গিয়ে বাসা বাঁধিল। নিজের সত্যিকার পরিচয় গোপন করল না। কলোনীতে একজন ডাক্তার থাকলে ভাল হয়‌, তা হোক নাম-কাটা। নিশানাথবাবু তাকে রেখে দিলেন।

‘নৃত্যকালী কলকাতায় রয়ে গেল। কোথায় থাকত জানি না‌, সম্ভবত ১৯ নম্বরে। বাড়ির ভাড়া আদায় করত‌, তাতেই চালাত। ডাক্তার মাসে একবার দু’বার যেত; হয়তো অবৈধ অপারেশন করত।

‘নৃত্যকালী সতীসাধবী একনিষ্ঠ স্ত্রীলোক ছিল। কিন্তু নিজের রূপ-যৌবন ছলাকলার ফাঁদ পেতে শিকার ধরা সম্বন্ধে তার মনে কোনও সঙ্কোচ ছিল না। ডাক্তারেরও অগাধ বিশ্বাস ছিল স্ত্রীর ওপর‌, সে জানত নৃত্যকালী চিরদিনের জন্য তারই‌, কখনও আর কারুর হতে পারে না।

‘বছর আড়াই আগে ওরা মতলব করল নৃত্যকালী সিনেমায় যোগ দেবে। সিনেমায় টাকা আছে‌, টাকাওয়ালা লোকও আছে। নৃত্যকালী সিনেমায় ঢুকাল। তার অভিনয় দেখে সকলে মুগ্ধ। নৃত্যকালী যদি সিধে পথে চলত‌, তাহলে সিনেমা থেকে অনেক পয়সা রোজগার করতে পারত। কিন্তু অবৈধ উপায়ে টাকা মারবার একটা সুযোগ যখন হাতের কাছে এসে গেল তখন নৃত্যকালী লোভ সামলাতে পারল না।

‘মুরারি দত্ত অতি সাধারণ লম্পট‌, কিন্তু সে জহরতের দোকানের মালিক। ডাক্তার আর নৃত্যকালী মতলব ঠিক করল। ডাক্তার নিকোটিন তৈরি করল। তারপর নির্দিষ্ট রাত্রে মুরারি দত্তর মৃত্যু হল; তার দোকান থেকে হীরের নেকলেস অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘প্রথমটা পুলিস জানতে পারেনি সে রাত্রে মুরারির ঘরে কে এসেছিল। তারপর রমেনবাবু ফাঁস করে দিলেন। নৃত্যকালীর নামে ওয়ারেন্ট বেরুল।

‘নৃত্যকালীর আসল চেহারার ফটোগ্রাফ ছিল না বটে‌, কিন্তু সিনেমা স্টুডিওর সকলেই তাকে দেখেছিল। কোথায় কার চোখে পড়ে যাবে ঠিক নেই‌, নৃত্যকালীর বাইরে বেরুনো বন্ধ হল। কিন্তু এভাবে তো সারা জীবন চলে না। ডাক্তার নৃত্যকালীর মুখের ওপর প্ল্যাস্টিক অপারেশন করল। কিন্তু শুধু সার্জারি যথেষ্ট নয়‌, দাঁত দেখে অনেক সময় মানুষ চেনা যায়। নৃত্যকালীর দুটো দাঁত তুলিয়ে ফেলে নকল দাঁত পরিয়ে দেওয়া হল। তার মুখের চেহারা একেবারে বদলে গেল। তখন কার সাধ্য তাকে চেনে।

‘তারপর ওরা ঠিক করল নৃত্যকালীরও কলোনীতে থাকা দরকার। স্বামী-স্ত্রীর এক জায়গায় থাকা হবে‌, তাছাড়া টোপ গেলবার মত মাছও এখানে আছে।

‘চায়ের দোকানে বিজয়বাবুর সঙ্গে নৃত্যকালীর দেখা হল; তার করুণ কাহিনী শুনে বিজয়বাবু গলে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে নৃত্যকালী কলোনীতে গিয়ে বসল। ডাক্তারের সঙ্গে নৃত্যকালীর পরিচয় আছে। কেউ জানল না‌, পরে যখন পরিচয় হল তখন পরিচয় ঝগড়ায় দাঁড়াল। সকলে জানল ডাক্তারের সঙ্গে নৃত্যকালীর আদায়-কাঁচকলায়।

‘নিশানাথ এবং দময়ন্তীর জীবনে গুপ্তকথা ছিল। প্রথমে সে কথা জানতেন বিজয়বাবু আর ব্ৰজদাস বাবাজী। কিন্তু নেপালবাবু তাঁর মেয়ে মুকুলকে নিয়ে কলোনীতে আসবার পর বিজয়বাবু মুকুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আবেগের মুখে তিনি একদিন পারিবারিক রহস্য মুকুলের কাছে প্রকাশ করে ফেলেলেন।–বিজয়বাবু্‌, যদি ভুল করে থাকি‌, আমাকে সংশোধন করে দেবেন।’

বিজয় নতমুখে নির্বাক রহিল। ব্যোমকেশ আবার বলিতে লাগিল–‘মুকুল ভাল মেয়ে। বাপ যতদিন চাকরি করতেন সে সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়েছে‌, তারপর হঠাৎ ভাগ্য-বিপর্যয় হল; কচি বয়সে তাকে অন্ন-চিন্তা করতে হল। সে সিনেমায় কাজ যোগাড় করবার চেষ্টা করল‌, কিন্তু হল না। তার গলার আওয়াজ বোধহয় ‘মাইকে ভাল আসে না। তিক্ত মন নিয়ে শেষ পর্যন্ত সে কলোনীতে এল এবং বারোয়ারী রাঁধুনীর কাজ করতে লাগল।

‘তারপর জীবনে এল ক্ষণ-বসন্ত‌, বিজয়বাবুর ভালবাসা পেয়ে তার জীবনের রঙ বদলে গেল। বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে‌, হঠাৎ আবার ভাগ্য-বিপর্যয় হল। বনলক্ষ্মীকে দেখে বিজয়বাবু মুকুলের ভালবাসা ভুলে গেলেন। বনলক্ষ্মী মুকুলের মত রূপসী নয়‌, কিন্তু তার একটা দুর্নিবার চৌম্বক শক্তি ছিল। বিজয়বাবু সেই চুম্বকের আকর্ষণে পড়ে গেলেন। মুকুলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিলেন।

0 Shares