চিড়িয়াখানা

‘প্ৰাণের জ্বালায় মুকুল নিশানাথবাবুর গুপ্তকথা বাপকে বলল। নেপালবাবুর উচ্চাশা ছিল তিনি কলোনীর কর্ণধার হবেন‌, তিনি তড়পাতে লাগলেন। কিন্তু হাজার হলেও অন্তরে তিনি ভদ্রলোক‌, blackmail-এর চিন্তা তাঁর মনেও এল না।

‘এদিকে বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তার অতীত জীবনের কলঙ্ক-কাহিনী জেনেও তাকে বিয়ে করবার জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। নিশানাথ কিন্তু বেঁকে দাঁড়ালেন‌, কুলত্যাগিনীর সঙ্গে তিনি ভাইপোর বিয়ে দেবেন না। বংশে একটা কেলেঙ্কারিই যথেষ্ট।

‘কাকার হুকুম ডিঙিয়ে বিয়ে করবার সাহস বিজয়বাবুর ছিল না‌, কাকা যদি তাড়িয়ে দেন তাহলে না খেয়ে মরতে হবে। দুই প্রেমিক প্রেমিকা মিলে পরামর্শ হল; দোকান থেকে কিছু কিছু টাকা সরিয়ে বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর কাছে জমা করবেন‌, তারপর যথেষ্ট টাকা জমলে দু’জনে কলোনী ছেড়ে চলে যাবেন। ওদিকে রসিক দে’র সঙ্গে বনলক্ষ্মী ঠিক অনুরূপ ব্যবস্থা করেছিল। রসিক কপৰ্দকহীন যুবক‌, সেও বনলক্ষ্মীকে দেখে মজেছিল; বনলক্ষ্মীর কলঙ্ক ছিল বলেই বোধহয় তার দিকে হাত বাড়াতে সাহস করেছিল। বনলক্ষ্মীও তাকে নিরাশ করেনি, ভরসা দিয়েছিল কিছু টাকা জমাতে পারলেই দু’জনে পালিয়ে গিয়ে কোথাও বাসা বাঁধবে। এইভাবে রসিক এবং বিজয়বাবুর টাকা ১৯ নম্বর মিজ লেনের লোহার আলমারিতে জমা হচ্ছিল।

‘তারপর একদিন বিজয়বাবু বনলক্ষ্মীর কাছেও পারিবারিক গুপ্তকথাটি বলে ফেললেন। ভাবপ্রবণ প্রকৃতির ঐ এক বিপদ‌, যখন আবেগ উপস্থিত হয় তখন অতিবড় গুপ্তকথাও চেপে রাখতে পারেন না।

‘গুপ্তকথা জানতে পেরে বনলক্ষ্মী সেই রাত্রেই ডাক্তারকে গিয়ে বলল; আনন্দে ডাক্তারের বুক নেচে উঠল। অতি যত্নে দু’জনে ফাঁদ পাতল। নিশানাথকে হুমকি দিতে গেলে বিপরীত ফল ফলতে পারে‌, কিন্তু দময়ন্তী স্ত্রীলোক‌, কলঙ্কের ভয় তাঁরই বেশি। সুতরাং তিনি blackmail-এর উপযুক্ত পাত্রী।

‘দময়ন্তী দেবীর শোষণ শুরু হল; আটি মাস ধরে চলতে লাগল। কিন্তু শেষের দিকে নিশানাথবাবুর সন্দেহ হল‌, তিনি আমার কাছে এলেন।

‘সুনয়না কলোনীতে আছে। এ সন্দেহ নিশানাথের কেমন করে হয়েছিল তা আমি জানি না‌, অনুমান করাও কঠিন। মানুষের জীবনে অতর্কিতে অভাবিত ঘটনা ঘটে‌, তেমনি কোনও ঘটনার ফলে হয়তো নিশানাথের সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে গবেষণা নিষ্ফল।

‘নিশানাথের নিমন্ত্রণ পেয়ে আমরা রমেন মল্লিককে সঙ্গে নিয়ে কলোনীতে গেলাম। রমেনবাবুকে ডাক্তার চিনত না কিন্তু সুনয়না চিনত; স্টুডিওতে অনেকবার দেখেছে‌, মুরারি দত্তর বন্ধু। তাই রমেনবাবুকে দেখে সুনয়না ভয় পেয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না‌, সুনয়নার খোঁজেই আমরা কলোনীতে এসেছি।

‘দাস-দম্পতি বড় দ্বিধায় পড়ল। এ অবস্থায় কী করা যেতে পারে? বনলক্ষ্মী যদি কিলোনী ছেড়ে পালায় তাহলে খুঁচিয়ে সন্দেহ জাগানো হবে‌, পুলিস কনলক্ষ্মীকে খুঁজতে আরম্ভ করবে। বনলক্ষ্মী যদি ধরা পড়ে‌, তার মুখে অপারেশনের সূক্ষ্ম চিহ্ন বিশেষজ্ঞের চোখে ধরা পড়ে যাবে‌, বনলক্ষ্মীই যে সুনয়না তা আর গোপন থাকবে না। তবে উপায়?

‘নিশানাথবাবু যত নষ্ট্রের গোড়া‌, তিনিই ব্যোমকেশ বক্সীকে ডেকে এনেছেন। তাঁর যদি হঠাৎ মৃত্যু হয় তাহলে সুনয়নার তল্লাস বন্ধ হয়ে যাবে‌, নিষ্কণ্টকে দময়ন্তী দেবীর রুধির শোষণ করা চলবে।

‘কিন্তু নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্ৰতিপন্ন হওয়া চাই। তাঁর ব্লাড-প্রেসার আছে‌, ব্লাড-প্রেসারের রুগী বেশির ভাগই হঠাৎ মরে-হার্টফেল হয়। কিম্বা মাথার শিরা ছিঁড়ে যায়। সুতরাং কাজটা সাবধানে করতে পারলে কারুর সন্দেহ হবার কথা নয়।

‘ভুজঙ্গধর ডাক্তার খুব সহজেই নিশানাথকে মারতে পারত। সে প্রায়ই নিশানাথের রক্ত-মোক্ষণ করে দিত। এখন রক্ত-মোক্ষণ ছুতোয় যদি একটু হাওয়া তাঁর ধমনীতে ঢুকিয়ে দিতে পারত‌, তাহলে তিন মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হত। অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশন দিলেও একই ফল হত; তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে কড়িকাঠে ঝোলাবার দরকার হত না। কিন্তু তাতে একটা বিপদ ছিল। ইনজেকশন দিলে চামড়ার ওপর দাগ থাক না থাক‌, শিরার ওপর দাগ থেকে যায়‌, পোস্ট-মর্টেম পরীক্ষায় ধরা পড়ে। নিশানাথের গায়ে ইনজেকশনের চিহ্ন পাওয়া গেলে প্রথমেই সন্দেহ হত। ডাক্তার ভুজঙ্গাধরের ওপর। সুতরাং ভুজঙ্গধর সে রাস্তা দিয়ে গেল না; অত্যন্ত স্কুল প্রথায় নিশানাথবাবুকে মারলে।

‘ব্যবস্থা খুব ভাল করেছিল। বেনামী চিঠি পেয়ে বিজয়বাবু কলকাতায় এলেন। ওদিকে লাল সিং-এর চিঠি পেয়ে রাত্রি দশটার সময় দময়ন্তী পিছনের দরজা দিয়ে কাচ-ঘরে চলে গেলেন। রাস্তা সাফ‌, ডাক্তার সেতার বাজাচ্ছিল‌, বনলক্ষ্মীর হাতে সেতার দিয়ে নিশানাথের ঘরে ঢুকল। সম্ভবত নিশানাথ তখন জেগে ছিলেন। ডাক্তার আলো জ্বেলেই জানালা বন্ধ করে দিলে। তারপর–

‘দুটো ভুল ডাক্তার করেছিল। কাজ শেষ করে জানোলাটা খুলে দিতে ভুলে গিয়েছিল‌, আর তাড়াতাড়িতে মোজা জোড়া খুলে নিয়ে যায়নি। এ দুটো ভুল যদি সে না করত তাহলে নিশানাথবাবুর মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে কারুর সন্দেহ হত না।

‘পানুগোপাল কিছু দেখেছিল। কী দেখেছিল তা চিরদিনের জন্যে অজ্ঞাত থেকে যাবে। আমার বিশ্বাস সে বাইরে থেকে ডাক্তারকে জানালা বন্ধ করতে দেখেছিল। নিশানাথের মৃত্যুটা যতক্ষণ স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হয়েছিল ততক্ষণ সে কিছু বলেনি‌, কিন্তু যখন বুঝতে পারল মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তখন সে উত্তেজিত হয়ে যা দেখেছিল তা বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার কপাল খারাপ‌, সে কিছু বলতে পারল না। ডাক্তার বুঝলে পানু কিছু দেখেছে। সে আর দেরি করল না‌, পানুর অবর্তমানে তার কানের ওষুধে নিকোটিন মিশিয়ে রেখে এল।

0 Shares