চিড়িয়াখানা

ব্যোমকেশ বলিল,–’সুনয়নার কথা আমরা কিছুই জানি না-নামটা ছাড়া। আপনার কাছে খবর পাব এই আশায় এসেছি।’

রমেনবাবু বলিলেন,–’ও-আমি ভেবেছিলাম। আপনি পুলিসের পক্ষ থেকে–। যা হোক্‌, নেত্যকালীর অনেক খবরই আমি জানি, কেবল ল্যাজা মুড়োর খবর পাইনি।’

‘সেটা কি রকম?’

‘নেত্যকালী কোথা থেকে এসেছিল জানি না‌, আবার কোথায় লোপাট হয়ে গেল তাও জানি না।‘

‘ভারি রহস্যময় ব্যাপার দেখছি। এর মধ্যে পুলিসের গন্ধও আছে!—আপনি যা যা জানেন দয়া করে বলুন।’

রমেনবাবু আমাদের সিগারেট দিলেন এবং দেশলাই জ্বালিয়া ধরাইয়া দিলেন। তারপর বলিতে আরম্ভ করিলেন,–’ঘটনাচক্ৰে নেত্যকালীর সিনেমালীলা প্রস্তাবনা থেকেই তাকে দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল; আর যবনিকা পতন পর্যন্ত সেই লীলার খবর যে রেখেছিলাম তার কারণ মুরারি আমার বন্ধু ছিল। মুরারি দত্তর নাম বোধ হয় আপনারা জানেন না। তার কথা পরে আসবে।

‘আজ থেকে আন্দাজ আড়াই বছর আগে একদিন সকালের দিকে আমি গৌরাঙ্গ স্টুডিওর মালিক গৌরহরিবাবুর অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটি নতুন মেয়ে দেখা করতে এল। গৌরহরিবাবু তখন ‘বিষবৃক্ষ ধরেছেন‌, প্রধান ভূমিকায় অ্যাকটর-অ্যাকট্রেস নেওয়া হয়ে গেছে‌, কেবল মাইনর পার্টের লোক বাকি।

‘সেই নেত্যকালীকে প্রথম দেখলাম। চেহারা এমন কিছু আহা-মারি নয়; তবে বয়স কম‌, চটক আছে। গৌরহরিবাবু ট্রাই নিতে রাজী হলেন।

‘ট্রাই নিতে গিয়ে গৌরহরিবাবুর তাক লেগে গেল। ভেবেছিলেন। ঝি চাকরানীর পার্ট দেবেন‌, কিন্তু অভিনয় দেখার পর বললেন‌, তুমি কুন্দনন্দিনীর পার্ট কর। নেত্যকালী। কিন্তু রাজী হল না‌, বললে‌, বিধবার পার্ট করবে না। গৌরহরিবাবু তখন তাকে কমলমণির পার্ট দিলেন। নেত্যকালী নাম সিনেমায় চলে না‌, তার নতুন নাম হল সুনয়না।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল,–’বিধবার পার্ট করবে না কেন?’

রমেনবাবু বলিলেন,–’কম বয়সী অভিনেত্রীরা বিধবার পার্ট করতে চায় না। তবে নেত্যকালী অন্য ওজর তুলেছিল; বলেছিল‌, সে সধবা‌, গোরস্ত ঘরের বৌ‌, টাকার জন্যে সিনেমায় নেমেছে‌, কিন্তু বিধবা সেজে স্বামীর অকল্যাণ করতে পারবে না। যাকে বলে নাচতে নেমে ঘোমটা।’

‘আশ্চর্য বটে! তারপর?’

‘গৌরহরিবাবু তাকে মাইনে দিয়ে রেখে দিলেন। শুটিং চলল। তারপর যথা সময় ছবি বেরুল। ছবি অবশ্য দাঁড়াল না‌, কিন্তু কমলমণির অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্য তার মেক-আপ। সে নিজে নিজের মেক-আপ করত; এত চমৎকার মেক-আপ করেছিল যে পদায় তাকে দেখে নেত্যকালী বলে চেনাই গেল না।’

‘তাই নাকি; আর অন্য যে সব ছবিতে কাজ করেছিল-?’

‘অন্য আর একটা ছবিতেই সে কাজ করেছিল‌, তারক গাঙ্গুলির ‘স্বৰ্ণলতায়। শ্যামা ঝি’র পার্ট করেছিল। সে কী অপূর্ব অভিনয়! আর শ্যামা ঝিাঁকে দেখে কার সাধ্য বলে সে-ই বিষবৃক্ষের কমলমণি। একেবারে আলাদা মানুষ!—এখন মনে হয় নেত্যকালীর আসল চেহারাও হয়তো আসল চেহারা নয়‌, মেক-আপ।’

‘তার আসল চেহারার ফটো বোধ হয় নেই?’

‘না। থাকলে পুলিসের কাজে লাগত।’

‘হুঁ। তারপর বলুন।’

রমেনবাবু আর একবার আমাদের সিগারেট পরিবেশন করিয়া আরম্ভ করিলেন—

‘এই তো গেল সুনয়নার সিনেমা-জীবনের ইতিহাস। ভেতরে ভেতরে‌, আর একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল। সুনয়না সিনেমায় ঢোকবার মাস দুই পরে স্টুডিওতেই মুরারির সঙ্গে তার দেখা হল। মুরারিকে আপনারা চিনবেন না‌, কিন্তু দত্ত-দাস কোম্পানির নাম নিশ্চয় শুনেছেন-বিখ্যাত জহরতের কারবার; মুরারি হল গিয়ে দত্তদের বাড়ির ছেলে। অগাধ বড়মানুষ।

‘মুরারি। আমার বন্ধু ছিল‌, এক গেলাসের ইয়ার বলতে পারেন। আমাদের মধ্যে‌, যাকে স্ত্রীদোষ বলে তা একটু আছে‌, ওটা তেমন দোষের নয়। মুরারিরও ছিল। পালে-পার্বণে একটু-আধটু আমোদ করা‌, বাঁধাবাঁধ কিছু নয়। কিন্তু মুরারি সুনয়নাকে দেখে একেবারে ঘাড় মুচড়ে পড়ল। সুনয়না এমন কিছু পরী-অন্সরী নয়‌, কিন্তু যার সঙ্গে যার মজে মন! মুরারি সকাল-বিকেল গৌরাঙ্গ স্টুডিওতে ধর্না দিয়ে পড়ল।

‘মুরারির বয়স হয়েছিল আমারই মতন। এ বয়সে সে যে এমন ছেলেমানুষী আরম্ভ করবে তা ভাবিনি। সুনয়না কিন্তু সহজে ধরা দেবার মেয়ে নয়। তার বাড়ি কোথায় কেউ জানত না‌, ট্রামে বাসে আসত‌, ট্রামে বাসে ফিরে যেত; কোনও দিন স্টুডিওর গাড়ি ব্যবহার করেনি। মুরারি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে বার করতে পারেনি তার বাসা কোথায়।

‘মুরারি। আমাকে মনের কথা বলত। আমি তাকে বোঝাতাম‌, সুনয়না ভদ্রঘরের বেী্‌্‌, ভয়ানক পতিব্ৰতা; ওদিকে তাকিও না। মুরারি কিন্তু বুঝত না। তাকে তখন কালে ধরেছে‌, সে বুঝবে কেন?

‘মাস ছয়-সাত কেটে গেল। সুনয়ন মুরারিকে আমল দিচ্ছে না‌, মুরারিও জোঁকের মত লেগে আছে। এইভাবেই চলছে।

‘স্বৰ্ণলতায় সুনয়নার কাজ শেষ হয়ে গেল। সে স্টুডিও থেকে দু’মাসের মাইনে আগাম নিয়ে কিছুদিনের ছুটিতে যাবে কাশ্মীর বেড়াতে‌, এমন সময় একদিন মুরারি এসে আমাকে বললে‌, সব ঠিক হয়ে গেছে। আশ্চর্য হলাম‌, আবার হলাম না। স্ত্রীজাতির চরিত্র‌, বুঝতেই পারছেন। সুনয়না যে অন্য মতলবে ধরা দেবার ভান করছে তা তখন জানব কি করে?

‘দত্ত-দাস কোম্পানির বাগবাজারের দোকানটা মুরারি দেখত। দোকানের পেছনদিকে একটা সাজানো ঘর ছিল। সেটা ছিল মুরারির আড়-ঘর‌, অনেক সময় সেখানেই রাত কাটাতো।

‘পরদিন সকালে হৈ হৈ কাণ্ড। মুরারি তার আডডা-ঘরে মরে পড়ে আছে। আর দোকানের শো-কেস থেকে বিশ হাজার টাকার হীরের গয়না গায়েব হয়ে গেছে।

0 Shares