চিড়িয়াখানা

‘পুলিস এল‌, লাস পরীক্ষার জন্যে চালান দিলে। কিন্তু কে মুরারিকে মেরেছে তার হদিস পেলে না। সে-রত্রে মুরারির ঘরে কে এসেছিল তা বোধ হয়। আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। মুরারি। আর কাউকে বলেনি।

‘আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেলাম। খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়বার ইচ্ছে মোটেই ছিল না‌, অথচ না বললেও নয়। শেষ পর্যন্ত কর্তব্যের খাতিরে পুলিসকে গিয়ে বললাম।

‘পুলিস অন্ধকারে হ্যাঁ করে বসে ছিল‌, এখন তুড়ে তল্লাস শুরু করে দিলে। সুনয়নার নামে ওয়ারেন্ট বেরুল। কিন্তু কোথায় সুনয়না! সে কাপুরের মত উবে গেছে। তার যে সব ফটোগ্রাফ ছিল তা থেকে সনাক্ত করা অসম্ভব। তার আসল চেহারা স্টুডিওর সকলকারই চেনা ছিল‌, কিন্তু এই ব্যাপারের পর আর কেউ সুনয়নাকে চোখে দেখেনি।

‘তাই বলেছিলাম সুনয়নার ল্যাজা-মুড়ো দুই-ই আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। সে কোথা থেকে এসেছিল‌, কার মেয়ে কার বৌ কেউ জানে না; আবার ভোজবাজির মত কোথায় মিলিয়ে গেল তাও কেউ জানে না।’

রমেনবাবু চুপ করিলেন। ব্যোমকেশও কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’মুরারিবাবুর মৃত্যুর কারণ জানা গিয়েছিল?’

রমেনবাবু বলিলেন,–’তার পেটে বিষ পাওয়া গিয়েছিল।’

‘কোন বিষ জানেন?’

‘ঐ যে কি বলে-নামটা মনে পড়ছে না–তামাকের বিষ।’

‘তামাকের বিষ! নিকোটিন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ‌, নিকোটিন। তামাক থেকে যে এমন দুদন্তি বিষ তৈরি হয় তা কে জানত?—আসুন।’ বলিয়া সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিলেন।

ব্যোমকেশ হাস্যমুখে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–’ধন্যবাদ‌, আর না। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। আপনি কোথাও বেরুচ্ছিলেন–’

‘সে কি কথা! বেরুনো তো রোজই আছে‌, আপনাদের মতো সজনদের সঙ্গ পাওয়া কি সহজ কথা–আমি যাচ্ছিলাম একটি মেয়ের গান শুনতে। নতুন এসেছে‌, খাসা গায়। তা এখনও তো রাত বেশি হয়নি‌, চলুন না। আপনারাও দুটো ঠুংরি শুনে আসবেন।’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল,–’আমি তো গানের কিছুই বুঝি না‌, আমার যাওয়া বৃথা; আর অজিত ধ্রুপদ ছাড়া কোনও গান পছন্দই করে না। সুতরাং আজ থাক। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আবার যদি খবরের দরকার হয়‌, আপনার শরণাপন্ন হব।’

‘একশ’বার। —যখনই দরকার হবে তলব করবেন।’

‘আচ্ছা‌, আসি তবে। নমস্কার।’

নমস্কার। নমস্কার।’

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া শুনিতে পাইলাম‌, পাশের ঘরে ব্যোমকেশ কাহাকে ফোন করিতেছে। দুই চারিটা ছাড়াছাড়া কথা শুনিয়া বুঝিলাম সে নিশানাথবাবুকে সুনয়নার কাহিনী শুনাইতেছে।

নিশানাথবাবুর আগমনের পর হইতে আমাদের তাপদগ্ধ কর্মহীন জীবনে নূতন সজীবতার সঞ্চার হইয়াছিল। তাই ব্যোমকেশ যখন টেলিফোনের সংলাপ শেষ করিয়া আমার ঘরে আসিয়া চুকিল এবং বলিল,–’ওহে ওঠে‌, মোহনপুর যেতে হবে’—তখন তিলমাত্ৰ আলস্য না করিয়া সটান উঠিয়া বসিলাম।

‘কখন যেতে হবে?’

‘এখনি। রমেনবাবুকেও নিয়ে যেতে হবে। নিশানাথবাবুর কথার ভাবে মনে হল তাঁর সন্দেহ ভূতপূর্ব অভিনেত্রী সুনয়না দেবী কাছাকাছি কোথাও বিরাজ করছেন। তাঁর সন্দেহ যদি সত্যি হয়‌, রমেনবাবু গিয়ে আসামীকে সনাক্ত করতে পারেন।’

আটটার মধ্যেই রমেনবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম। তিনি লুঙ্গি ও হাতকটা গেঞ্জি পরিয়া বৈঠকখানায় ‘আনন্দবাজার’ পড়িতেছিলেন‌, আমাদের সহৰ্ষে স্বাগত করিলেন।

ব্যোমকেশের প্রস্তাব শুনিয়া তিনি উল্লাসভরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, বলিলেন–‘ যাব না? আলবৎ যাব। আপনারা দয়া করে পাঁচ মিনিট বসুন‌, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’ বলিয়া তিনি অন্দরের দিকে অন্তধান করিলেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি তৈয়ার হইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। একেবারে ফিট্‌ফাট বাবু; যেমনটি কাল সন্ধ্যায় দেখিয়াছিলাম।

শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছিয়া তিনি আমাদের টিকিট কিনিতে দিলেন না‌, নিজেই তিনখানা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া ট্রেনে অধিষ্ঠিত হইলেন। দেখিলাম আমাদের চেয়ে তাঁরই ব্যগ্রতা ও উৎসাহ বেশি।

ঘন্টাখানেক পরে উদ্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছান গেল। লোকজন বেশি নাই; বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, পানের দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া একটি লোক পান চিবাইতে চিবাইতে দোকানির সহিত রসালাপ করিতেছে। ব্যোমকেশ নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল,–’গোলাপ কলোনী কোন দিকে বলতে পারেন?’

লোকটি এক চক্ষু মুদিত করিয়া আমাদের ভাল করিয়া দেখিয়া লইল‌, তারপর এড়ো গলায় বলিল,–’চিড়িয়াখানা দেখতে যাবেন?’

‘চিড়িয়াখানা!’

‘ঐ যার নাম চিড়িয়াখানা তারই নাম গোলাপ কলোনী। আজব জায়গা-আজব মানুষগুলি। আমন চিড়িয়াখানা আলিপুরেও নেই। তা-যাবার আর কষ্ট কি? ঐ যে চিড়িয়াখানার রথ রয়েছে ওতে চড়ে বসুন‌, গড়গড় করে চলে যাবেন।’

এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই‌, স্টেশন-প্রাঙ্গণের এক পাশে একটি জীর্ণকায় ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েদের স্কুল-কলেজের গাড়ির মত লম্বা ধরনের গাড়ি। তাহার গায়ে এককালে সোনার জলে গোলাপ কলোনী লেখা ছিল‌, কিন্তু এখন তাহা প্ৰায় অবোধ্য হইয়া পড়িয়াছে। গাড়িতে লোকজন কেহ আছে বলিয়া বোধ হইল না‌, কেবল ঘোড়াটা একক দাঁড়াইয়া পা ছুঁড়িয়া মাছি তাড়াইতেছে।

কাছে গিয়া দেখিলাম গাড়ির পিছনের পা-দানে বসিয়া একটি লোক নিবিষ্টমনে বিড়ি টানিতেছে। লোকটি মুসলমান‌, বয়স হইয়াছে। দাড়ির প্রাচুর্য নাই‌, মুখময় ডুমো ডুমে ব্রণের ন্যায় মাংস উঁচু হইয়া আছে‌, চোখ দু’টিতে ঘোলাটে অভিজ্ঞতা; পরনে ময়লা পায়জামার উপর ফতুয়া। আমাদের দেখিয়া সে বিড়ি ফেলিয়া উঠিয়া বলিল,–’কলকাতা হতে আসতেছেন?’

0 Shares