চিড়িয়াখানা

‘হ্যাঁ। গোলাপ কলোনী যাব।’

‘আসেন। আপনাগোরে লইয়া যাইবার কথা বাবু কইছেন। কিন্তু মুস্কিল হইছে—’

বুঝিলাম ইনিই মুস্কিল মিঞা। ব্যোমকেশ বলিল,–’মুস্কিল কিসের?’

মুস্কিল বলিল,–’রসিকবাবুরাও এই টেরেনে আওনের কথা। তা তিনি আইলেন না। পরের টেরানের জৈন্য সবুর করতি হইব। তা বাবু মশায়রা গাড়ির মধ্যে বসেন।’

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’রসিকবাবুটি কে?’

মুস্কিল বলিল,–’কলোনীর বাবু্‌, রোজ দুবেলা রেলে আয়েন যায়েন‌, আজ কি কারণে দেরি হইছে। বসেন না‌, পরের গাড়ি এখনই আইব।’

মুস্কিল গাড়ির দ্বার খুলিয়া দিল। ভিতরে মানুষ বসিবার স্থান তিন চারিটি আছে‌, কিন্তু অধিকাংশ স্থান স্তুপীকৃত শূন্য চ্যাঙারির দ্বারা পূর্ণ। অনুমান করা যায় প্রত্যহ প্রাতে এইসব চ্যাঙারিতে গোলাপ কলোনী হইতে ফুল শাকসবজি স্টেশনে আসে এবং কলিকাতার অভিমুখে রওনা হইয়া যায়; ওদিকে কলিকাতা হইতে পূর্বদিনের শূন্য চ্যাঙারিগুলি ফিরিয়া আসে। কমী মানুষগুলিরও যাতায়াত এই ভ্যানের সাহায্যেই সাধিত হয়।

রৌদ্রের তাপ বাড়িতেছিল। বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকার চেয়ে গাড়ির ছায়াস্তরালে প্রবেশ করাই শ্ৰেয় বিবেচনা করিয়া আমরা গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম।

মুস্কিল মিঞা। গাল্পিক লোক‌, মানুষ পাইলে গল্প করিতে ভালবাসে। সে বলিল,–’বাবু মশায়রা দুই-চারিদিন হেথায় থাকবেন তো?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’আজই ফিরব। —তুমি মুস্কিল মিঞা?’

মুস্কিল মুখ মচুকাইয়া বলিল,–’নাম তো কর্তা  সৈয়দ নুরুদ্দিন। কিন্তু মুস্কিল হৈছে বাবুরা আব্দর কৈরা মুস্কিল মিঞা ডাকেন।’

‘এ আর মুস্কিল কি?-কতদিন আছো গোলাপ কলোনীতে?’

‘আন্দাজ সাত আট বছর হৈতে চলল। তখন বোষ্টম ঠাকুর ছাড়া আর কোনও কতাই দেখা দেন নাই। আমি পুরান লোক।’

‘হুঁ। তোমার গাড়ি আর ঘোড়াও তো বেশ পুরান মনে হচ্ছে।’ মুস্কিল আক্ষেপ করিয়া বলিল,–’আর কন কেন কতা। ঘোড়াডার মরবার বয়স হইছে, নেহাৎ আদত পড়ে গেছে তাই গাড়ি টানে। বড়বিবিরে কতবার কইছি‌, ও দুটো গাড়ি ঘোড়ারে বাতিল কৈরা নূতন মটর-ভ্যান খরিদ কর। তা মুস্কিল হৈছে‌, বড়বিবি কয় টাকা নাই।’

‘বড়বিবি কে? নিশানাথবাবুর স্ত্রী?’

‘হ। ভারি লক্ষ্মীমন্তর মেইয়া।’

‘তিনিই বুঝি কলোনী দেখাশোনা করেন?’

‘দেখাশুনা কর্তাবাবুও করে। কিন্তু টাকাকড়ি হিসাব-নিকাশ বড়বিবির হাতে।’

‘তা বড়বিবি টাকা নাই বলে কেন? কিলোনীর ব্যবসা কি ভাল চলে না?’

মুস্কিল মিঞার ঘোলাটে চোখে একটা গভীর অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল,–’চলে তো ভালই। এত ফুল ফল ঘি মাখন আণ্ডা যায় কোথায়? তবে কি জানেন কতা‌, লাভের গুড় পিপড়া খাইয়া যায়।’ ইঙ্গিতপূর্ণ চক্ষে আমাদের তিনজনকে একে একে নিরীক্ষণ করিল।

মুস্কিল মিঞার নিকট হইতে ব্যোমকেশ হয়তো আরও আভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্ৰহ করিত‌, কিন্তু এই সময় দক্ষিণ হইতে একটি ট্রেন আসিয়া স্টেশনে থামিল। এবং অল্পকাল পরে একটি ক্ষিপ্রচারী ভদ্রলোক আসিয়া গাড়ির কাছে দাঁড়াইলেন। ইনি বোধ হয় রসিকবাবু।

ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ‌, কিন্তু আকৃতি স্নান ও শুষ্ক। বৃষিকাষ্ঠের মত দেহে লংক্লথের পাঞ্জাবি অত্যন্ত বেমানানভাবে বুলিয়া আছে‌, গাল-বসা খাপরা-ওঠা মুখ‌, জোড়া ভুরুর নিচে চোখদু’টি ঘন-সন্নিবিষ্ট‌, মুখে খুঁৎখুঁতে অতৃপ্ত ভাব। গাড়ির মধ্যে আমাদের বসিয়া থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মুখ আরও খুঁৎখুঁতে হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,–’আপনারা—?’

ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় দিয়া বলিল,–’নিশানাথবাবু আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন–।’

রসিকবাবুর ঘন-সন্নিবিষ্ট চোখে একটা ক্ষণস্থায়ী আশঙ্কা পালকের জন্য চমকিয়া উঠিল; মনে হইল তিনি ব্যোমকেশের নাম জানেন। তারপর তিনি চাটু করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বলিলেন,–’মুস্কিল‌, গাড়ি হাঁকাও। দেরি হয়ে গেছে।’

মুস্কিল ইতিমধ্যে সামনে উঠিয়া বসিয়াছিল‌, ঘোড়ার নিতম্বে দু’চার ঘা খেজুর ছড়ি বসাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

রসিকবাবু তখন আত্ম-পরিচয় দিলেন। তাঁহার নাম রসিকলাল দে‌, গোলাপ কলোনীর বাসিন্দা‌, হগ সাহেবের বাজারে তরিতরকারির দোকানের ইন-চার্জ।

এই সময় তাঁহার ডান হাতের দিকে দৃষ্টি পড়িতে চমকিয়া উঠিলাম। হাতের অঙ্গুষ্ঠ ছাড়া বাকি আঙুলগুলা নাই‌, কে যেন ভোজালির এক কোপে কাটিয়া লইয়াছে।

ব্যোমকেশও হাত লক্ষ্য করিয়াছিল‌, সে শাস্তস্বরে বলিল,–’আপনি কি আগে কোনও কল-কারখানায় কাজ করতেন?’

রসিকবাবু হাতখানি পকেটের মধ্যে লুকাইলেন‌, স্নানকণ্ঠে বলিলেন,–’কটন মিলের কারখানায় মিস্ত্রি ছিলাম‌, ভাল মাইনে পেতাম। তারপর করাত-মেসিনে আঙুলগুলো গেল; কিছু খেসারৎ পেলাম বটে‌, ন্যাকের বদলে নরুন! কিন্তু আর কাজ। জুটল না। বছর দুই থেকে নিশানাথবাবুর পিজরাপোলে আছি।’ তাঁহার মুখ আরও শীর্ণ-ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল।

আমরা নীরব রহিলাম। গাড়ি ক্ষুদ্র শহরের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী পার হইয়া খোলা মাঠের রাস্তা ধরিল।

ভাবিতে লাগিলাম‌, গোলাপ কলোনীর দেখি অনেকগুলি নাম! কেহ বলে চিড়িয়াখানা‌, কেহ। বলে পিজরাপোল। না জানি সেখানকার অন্য লোকগুলি কেমন! যে দুইটি নমুনা দেখিলাম তাহাতে মনে হয় চিড়িয়াখানা ও পিজরাপোল দু’টি নোমই সার্থক।

রাস্তাটি ভাল; পাশ দিয়া টেলিফোনের খুঁটি চলিয়াছে। যুদ্ধের সময় মার্কিন পথিকৃৎ এই পথ ও টেলিফোনের সংযোগ নিজেদের প্রয়োজনে তৈয়ার করিয়াছিল‌, যুদ্ধের শেষে ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছে।

পথের শেষে আরও যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়িল; একটা স্থানে অগণিত সামরিক মোটর গাড়ি। পাশাপাশি শ্রেণীবদ্ধভাবে গাড়িগুলি সাজানো; সবাঙ্গে মরিচা ধরিয়াছে‌, রঙ চটিয়া গিয়াছে‌, কিন্তু তাহাদের শ্রেণীবিন্যাস ভগ্ন হয় নাই। হঠাৎ দেখিলে মনে হয় এ যেন যান্ত্রিক সভ্যতার গোরস্থান।

0 Shares