এই সমাধিক্ষেত্র যেখানে শেষ হইয়াছে সেখান হইতে গোলাপ কলোনীর সীমানা আরম্ভ। আন্দাজ পনরো-কুড়ি বিঘা জমি কাঁটা-তারের ধারে ধারে ত্রিশিরা ফণিমনসার ঝাড়। ভিতরে বাগান, বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাল টালি ছাওয়া ছোট ছোট কুঠি। মালীরা রবারের নলে করিয়া বাগানে জল দিতেছে। চারিদিকের ঝলসানো পারিবেশের মাঝখানে গোলাপ কলোনী যেন একটি শ্যামল ওয়েসিস।
ক্ৰমে কলোনীর ফটকের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। ফটকে দ্বার নাই, কেবল আগড় লাগাইবার ব্যবস্থা আছে। দুইদিকের স্তম্ভ হইতে মাধবীলতা উঠিয়া মাথার উপর তোরণমাল্য রচনা করিয়াছে। গাড়ি ফটকের ভিতর প্রবেশ করিল।
ফটকে প্রবেশ করিয়া সম্মুখেই একটি বাড়ি। টালির ছাদ, বাংলো ধরনের বাড়ি; নিশানাথবাবু এখানে থাকেন। আমরা গাড়ির মধ্যে বসিয়া দেখিলাম বাড়ির সদর দরজার পাশে দাঁড়াইয়া একটি মহিলা ঝারিতে করিয়া গাছে জল দিতেছেন। গাড়ির শব্দে তিনি মুখ ফিরাইয়া চাহিলেন; ক্ষণেকের জন্য একটি সুন্দরী যুবতীর মুখ দেখিতে পাইলাম। তারপর তিনি ঝারি রাখিয়া দ্রুত বাড়ির মধ্যে প্ৰবেশ করিলেন।
আমরা তিনজনেই যুবতীকে দেখিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ বক্ৰচক্ষে একবার রমেনবাবুর পানে চাহিল। রমেনবাবু অধরোষ্ঠ সঙ্কুচিত করিয়া অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িলেন, কথা বলিলেন না। লক্ষ্য করিয়াছিলাম, কলিকাতার বাহিরে পা দিয়া রমেনবাবু কেমন যেন নিবাক হইয়া গিয়াছিলেন। কলিকাতার যাঁহারা খাস বাসিন্দা তাঁহার কলিকাতার বাহিরে পদাৰ্পণ করিলে ডাঙায় তোলা মাছের মত একটু অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।
গাড়ি আসিয়া দ্বারের সম্মুখে থামিলে আমরা একে একে অবতরণ করিলাম। নিশানাথবাবু দ্বারের কাছে আসিয়া আমাদের সম্ভাষণ করিলেন। পরিধানে ঢিলা পায়জামা ও লিনেনের কুতর্গ। হাসিমুখে বলিলেন,–’আসুন! রোদুরে খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়।’—এই পর্যন্ত বলিয়া রসিক দে’র প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। রসিক দে আমাদের সঙ্গে গাড়ি হইতে নামিয়াছিল এবং অলক্ষিতে নিজের কুঠির দিকে চলিয়া যাইতেছিল। তাহাকে দেখিয়া নিশানাথবাবুর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল, তিনি বলিলেন,–’রসিক, তোমার হিসেব এনেছ?’
রসিক যেন কুঁচুকাইয়া গেল, ঠোঁট চাটিয়া বলিল,–’আজ্ঞে, আজ হয়ে উঠল না। কাল-পরশুর মধ্যেই—
নিশানাথবাবু আর কিছু বলিলেন না, আমাদের লইয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন।
বসিবার ঘরটি মাঝারি। আয়তনের; আসবাবের জাঁকজমক নাই। কিন্তু পারিপাট্য আছে। মাঝখানে একটি নিচু গোল টেবিল, তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটা গন্দিযুক্ত চেয়ার। দেয়ালের গায়ে বইয়ের আলমারি। এক কোণে টিপাইয়ের উপর টেলিফোন, তাহার পাশে রোল টপ টেবিল। বাহিরের দিকের দেয়ালে দু’টি জানালা, উপস্থিত রৌদ্রের ঝাঁঝ নিবারণের জন্য গাঢ় সবুজ রঙের পদাৰ্থ দিয়া ঢাকা।
রমেনবাবুর পরিচয় দিয়া আমরা উপবিষ্ট হইলাম। নিশানাথবাবু বলিলেন,–’তেতে পুড়ে এসেছেন, একটু জিরিয়ে নিন। তারপর বাগান দেখাব। এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গেও পরিচয় হবে। ‘ তিনি সুইচ টিপিয়া বৈদ্যুতিক পখা চালাইয়া দিলেন।
ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, —’আপনার বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে দেখছি।’
নিশানাথবাবু বলিলেন,–’হ্যাঁ, আমার নিজের ডায়নামো আছে। বাগানে জল দেবার জন্যে কুয়ো থেকে জল পাম্প করতে হয়। তাছাড়া আলো-বাতাসও পাওয়া যায়।’
আমিও ছাদের দিকে দৃষ্টি তুলিয়া দেখিলাম টালির নিচে সমতল করিয়া তক্তা বসানো, তক্তা ভেদ করিয়া মোটা লোহার ডাণ্ডা বাহির হইয়া আছে, ডাণ্ডার বাঁকা হুক হইতে পাখা বুলিতেছে। অনুরূপ আর একটা ডাণ্ডার প্রান্তে আলোর বালব।
পখা চালু হইলে তাহার উপর হইতে কয়েকটি শুষ্ক ঘাসের টুকরা ঝরিয়া টেবিলের উপর পড়ল। নিশানাথ বললেন, —’চড়ুই পাখি। কেবলই পাখার ওপর বাসা বাঁধবার চেষ্টা করছে। ক্লান্তি নেই, নৈরাশ্য নেই, যতবার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ততবার বাঁধছে।’ তিনি ঘাসের টুকরাগুলি কুড়াইয়া জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিয়া আসিলেন।
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল,–‘ভারি একহুঁয়ে পাখি।’
নিশানাথবাবুর মুখে একটু অন্ত্রর সাক্ত হাসি দেখা দিল, তিনি বলিলেন,–’এই একগুঁয়েমি যদি মানুষের থাকত’
ব্যোমকেশ বলিল,–’মানুষের বুদ্ধি বেশি, তাই একগুয়েমি কম।’ নিশানাথ বলিলেন,–’তাই কি? আমার তো মনে হয় মানুষের চরিত্র দুর্বল, তাই একগুঁয়েমি কম।’
ব্যোমকেশ তাঁহার পানে হাস্য-কুঞ্চিত চোখে চাহিয়া থাকিয়া বলিল,–’আপনি দেখছি মানুষ জাতটাকে শ্রদ্ধা করেন না।’
নিশানাথ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া হাল্কা সুরে বলিলেন,–’বর্তমান সভ্যতা কি শ্রদ্ধা হারানোর সভ্যতা নয়? যারা নিজের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়েছে তারা আর কাকে শ্রদ্ধা করবে?’
ব্যোমকেশ উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল এমন সময় ভিতর দিকের পদ নড়িয়া উঠিল। যে মহিলাটিকে পূর্বে গাছে জল দিতে দেখিয়াছিলাম তিনি বাহির হইয়া আসিলেন; তাঁহার হাতে একটি ট্রের উপর কয়েকটি সরবতের গেলাস।
মহিলাটিকে দূর হইতে দেখিয়া যতটা অল্পবয়স্ক মনে হইয়াছিল আসলে ততটা নয়। তবে বয়স ত্রিশ বছরের বেশিও নয়। সুগঠিত স্বাস্থ্যপূর্ণ দেহ, সুশ্ৰী মুখ, টকটকে রঙ; যৌবনের অপরপ্রান্তে আসিয়াও দেহ যৌবনের লালিত্য হারায় নাই। সবার উপর একটি সংযত আভিজাত্যের ভাব।
তিনি কে তাহা জানি না, তবু আমরা তিনজনেই সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলাম। নিশানাথবাবু নীরস কণ্ঠে পরিচয় দিলেন, —’আমার স্ত্রী–দময়ন্তী।’